“প্যাস্টেলে জাগে ভোর"- সাদামাটা ছবির সংগীত
কবি তপন গোস্বামীর নতুন কাব্যগ্রন্থ ‘প্যাস্টেলে জাগে ভোর’ বইটা হাতে পেয়েই বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতে হয় বইটির প্রচ্ছদের দিকে। পুকুরে ঢিল ফেললে গোলাকার তরঙ্গ সৃষ্টি হয়, অনুরূপভাবে প্রচ্ছদটিতেও যেন বর্ণ্ময় বিচিত্র বোধের অবয়ব ক্রমশ বিস্তৃতি লাভ করেছে। এই চেতনার বর্ণময় বলয়ের ভিতর প্রস্ফুটিত ফুলটি সৃষ্টির প্রতীক। অনুভবের সৌরভে মুখরিত।
অনুভূতিদেশ থেকে আলো না পেলে নেহাতই নিরাশ্রয় শব্দের কংকাল পরে থাকে সাদা পাতার উপর। কবিতাসৃজন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। বিস্তর যুক্তি-তর্ক-প্রতিতর্কের তাত্ত্বিক লক্ষণ্রেখা পেরিয়ে ঠিক কি ধরনের কবিতার কাছে ফিরে আসতে চান পাঠকরা? –সহজ অনাড়ম্বর শব্দের কাছে। কবিতা তো মানবমনের অকৃত্রিম স্বতঃস্ফূর্ত ভাবোচ্ছ্বাস। রোমাণ্টিক কবি ওয়ার্ডস্ওয়ার্থ যাকে বলেছেন, “spontaneous overflow of human feelings... it takes its origin in emotions recollected in tranquility”. ‘Recollection’ –স্মৃতিচারণ শব্দটি সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ। স্মৃতির মণিকোঠয়ায় কত আশ্চর্য ছবিই তো সণচিত থাকে। কবিতার কাকচক্ষু জলে ভেসে ওঠে জীবনের নিষ্পলক প্রতিবিম্ব।
ছবির সাথে কবিতার এই নিবিড় যোগসূত্র অজান্তেই নির্মাণ করে intertextuality এর এক অনন্য পরিসর। চিত্রকর ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলেন বর্ণময় কবিতা আর কবি সাদাপাতের শূনয়তাকে শব্দের ছবিতে সাজিয়ে তোলেন। কবিতায় চিত্রধর্মিতা বোধ হয় ‘চর্যাপদ’ এর সময় থেকেই উপস্থিত।
এই কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায়কবি নিজেই জানিয়েছেন-
কবিতাগুলোর মধ্যে যদি কোনো মিল থাকে তাহলে সেটা চিত্রধর্মিতায়।
সব কবিতাতেই আমি কোনো না কোনো একটা ছবি আঁকতে চেয়েছি।
কাব্যগ্রন্থটির কবিতাগুলি শিরোনামহীন। রচনাক্রম অনুযায়ী কবিতাগুলিকে সাজানো হয়েছে। এ এক ধারাবাহিক যাপঞ্চিত্র। আমাদের সাদামাটা যাপিত জীবন প্রতি মুহুর্তে টুকরো টুকরো অসংখ্য ছবি আমাদের উপহার দেয়। সাধারন মানুষের স্মৃতিতে সেই ছবি হারিয়ে যায় কিন্তু কবির স্মৃতিপটে প্রোজ্জ্বল সেই ছবি নিরন্তর নব নব রূপে জেগে ওঠে। আশ্চর্য আবিষ্কারের নেষায় বঁউদ হয়ে থাকা শব্দশ্রমিক তখন গভীর অভিনিবেশ সহকারে তা ফুটিয়ে তোলেন সাদাপাতায়। এখানেই শব্দের মুক্তি, সৃষ্টির উদ্ভাস।
শব্দ জেগে ওঠে বর্ণময় ছবি হিসাবে। এই ছবি আমাদের চিরপরিচিত দৈনন্দিন জীবনের অচেনা ছবি। আঙ্গিক অনুসারে, চিত্রকল্পের পরিবেশনায় চেনা ছবি অচেনা ঠেকে। প্রখ্যাত সমালোচক Walter Pater হয়ত এই পরিবেশনাকেই বলেছেন, “addition of strangeness to beauty” আর উত্তরাধুনিক সমালোচক Shklovosky তার ‘Art as Technique’ প্রবন্ধে এ সম্পর্কে বলেছেন, “ The technique of art is to make objects unfamiliar...”. কবিতায় চিত্রকল্পকোনো সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশ দেয় না বরং একসঙ্গে মনের অনেকগুলো জানলা খুলে দেয়। উম্নুক্ত হয় ভাবনা-চিন্তা ও বিশ্লেষণের বিবিধ অভিমুখ। উত্তরাধুনিক চিত্রকল্প বিভিন্নধর্মী ও বহুমুখী(polyphonic)।
জলে নেমেছে চাঁদ
তার খিদে মানুষের চৌকাঠ।
এর কোনো দৃশ্যরূপ নেই।
একপলক পরাবাস্তবের ছোঁয়া কিন্তু ফুটে উঠেছে সাধারণ জীবনের দৃশ্য। খিদের গন্ধমাখা অতি সাধারণ জিবনের দৃশ্য। খিদের গন্ধমাখা অতি সাধারণ মানুষের চৌকাঠ। এই দৃশ্যরূপ চিরন্তন। নিসর্গের অনাবিল সৌন্দর্যের ভিতর ‘খিদে’, ‘মানুষের চৌকাঠ’ নিবিড়ভাবে একাকার হয়ে গেছে। এখানেই কবিতাটির সার্থকতা।
শহিদ তর্পনের মতো বৃষ্টিধারা
এসো আজ দুইহাতে ধরি
মরা ডালপালা নিয়ে এখনও যে জেগে আছে
অশ্বত্থের গাছ
এসো তার তর্পন করি।
সত্যিই তো এই তর্পন আমাদের প্রতিনিয়ত করা উচিত। কৌরব পত্রিকার সম্পাদক প্রখ্যাত কবি কমল চক্রবর্তী গাছকে দেবতা হিসাবে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। তার নিজ হাতে সৃষ্টি ‘ভালোপাহাড়ে’ তিনি ‘বৃক্ষনাথের’ সেবা করেন। সেবাই তো পূজা। যন্ত্রসভ্যতার দুরন্ত অগ্রগতি ক্রমশ গ্রাস করে নিচ্ছে সবুজ চরাচর। একটি গাছে মৃত্যু(পড়ুন হত্যা) আসলে আমাদের অন্তরে স্থিত সজীব দূষণ্মুক্ত পৃথিবীর স্বপ্নের মৃত্যু। এমতাবস্থায় কবির স্বগোতক্তি
বাতিল নৌকার মাঝি, বর্ণহীন বিষন্ন করবী
কিছুই পারি না তাই, আমি আঁকি তোমাদের ছবি।
‘বাতিল’, ‘বর্ণহীন’ এই বিশ্লেষণগুলি বিষন্নতার আবহকে গাঢ় করে তোলে। সেই আবহে জেগে ওঠে ছবি। মোম রঙে আঁকা জীবনের ছবি। কবি যেন এক বিবর্ণ বিকেল্বেলায় নদীতীরে দাঁড়িয়ে আছেন। দেখতে পাচ্ছেন বহমান জীবনস্রোত। আমাদের সামনে তুলে ধরছেন সেই ছবি। কীভাবে নির্মিত হয় সেই ছবি? সুতীব্র সংগ্রাম তার নির্জনতা মিশে থাকে সেই সৃষ্টির অন্তঃস্থলে।
ছবির নেপথ্যে থাকে কিছু ঘাম, কিছু রক্তপাত
খিদে পেলে এই ছবি, তুমি দিয়ো একমুঠো ভাত।
প্রতিটি সৃষ্টির ভিতর মিশে থাকে এই ‘ঘাম’, ‘রক্তপাত’। ে তো স্রষ্টার আজীবন নির্মম প্রচেষ্টার পরিণতি। কবিতার শেষ পঙক্তিটি মর্মস্পর্শী।
এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলিতে ফুটে উঠেছে আশ্চর্য সব চিত্রকল্প। যেমন আমরা পাই ৬নং কবিতায়। কবিতাটি পড়তে পড়তে চন্দ্রালোকিত স্তব্ধ এক নিরজন নদীপ্রান্তরে পৌঁছে যান পাঠক। পাঠকই যেন সেই ‘যুবক’ যে ‘হারানো চিঠির খোঁজে’ এওতদূর এসেছে। সময়ের অনিবার্য বিস্মৃতি পেরিয়ে সে খুঁজে নিতে চাইছে ‘নষ্ট লিপির ক্যানভাস’। লিপিকার কালের স্রোতে বিলীন হয়ে গেছেন। পরে আছে তার ক্ষয়িষ্ণু সৃষ্টি। প্রত্নতাত্ত্বিক হয়ে সেই লিপির পাঠোদ্ধারে নেমেছেন পাঠক। একান্ত ব্যক্তিগত এই অনুভব আবার ফিরে এল কবিতাটি পড়ে।
কথা, কবিতা আর ছবির জন্য সমস্ত জীবন জুড়ে শিল্পীর অপেক্ষা। এই প্রতীক্ষার গর্ভগৃহে সাধনারত কবি অনুভব করেন
রক্তে হিম ঝরে, আর আমার মনে পড়ে
সেই কবিতার কথা
এতটা বয়স হল যার মুখ
আমি আজও দেখিনি
ঘুমের মধ্যে শুধু তার হাঁটাচলা
স্পষ্ট টের পাই।
আবার পরিচিত চৌহদ্দির মধ্যেই কবি খোঁজেন ঐশ্বররয-
চারিদিকে ছড়ানো ধান
মাটির এতটাই টান
অজস্র চড়ুই পাখি, কাক
থাক
আমার শরীর এই মাটির ওপরে তোরা রাখ।
এমন সহজ জীবনের চালচিত্র কাব্যগ্রন্থটির ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে পড়েছে অনাবিল রোদ্দুর হয়ে।
‘আদম’ কবিতা পত্রিকায়(ডিসেম্বর ২০০৫) অরিন্দম নিয়োগী লিখেছিলেন
সংখ্যাতত্ত্বের বিচারে বাংলা কবিতার প্রায় নব্বই ভাগেই রয়েছে
ছবির উপস্থিতি। বাকি দশ শতাংশ কবিতায় ছবি অনুপস্থিত
থাকলেও তা ছবি নিরপেক্ষ নয়।
‘প্যাস্টেলে জাগে ভোর’ কাব্যগ্রন্থটির প্রতিটি চিত্রকল্প শুধুমাত্র ছবির ধারণায় সীমাবদ্ধ হয়ে থাকেনি বরং তার মধ্যে মিশে আছে বোধের গভীর স্পন্দন। এখানেই কাব্যগ্রন্থটির উত্তরণ –এজন্যই আগ্রহী পাঠককে বারবার ফিরে আসতে হবে এই কাব্যগ্রন্থটির কাছে।
Post a Comment