অন্য উড়ানঃ সুপ্রভাত রায়

          


সুপ্রভাত রায়


শারীরিক
আজ আবার...আজ আবার...বাইক পাংচার। কাল দুপুরেই একটি অশ্লীল সাইজের পেরেক বাইক এর পিছনের চাকার ভিতর ঘরে এমন বেঁকেচুরে ঢুকে গেছিল যে পাংচার সারানোর মোবাইল আশিষদা প্লাস দিয়ে ওটা বের করার পর অভিঞ্জ ডাক্তারের মতো ওটা চোখের সামনে তুলে ধরল প্লাস সমেত। দিয়ে সামনের দোকানদারকে দেখাল পেরেকটার সাইজ। দোকানদার করুণ মুখ করার আপ্রাণ চেষ্টা করে আমার দিকে তাকাল। আমি যেন গভীর অসুখ করা রুগির অভিভাবক। টিউবটা পাল্টাতে হল। ওইটুকু সহবাসেই টিউব হাওয়া ধরে রাখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল এক্কেবারে। স্কুল কলেজে নতুননতুন প্রেমে যেমন সারাক্ষণ মনে হয় এই বুঝি প্রেমিকা ছেড়ে চলে গেল—যাদের বাইক আছে তারা জানে নির্জন রাস্তায় ওই রকমই সারাক্ষণ মনে হয় এই বুঝি হাওয়া ছেড়ে চলে গেল টিউব কে। আজ আবার... হাইওয়েতে। মাথাটা শান্ত করে দাঁড়ালাম। বাইকটা স্ট্যান্ড করলাম। দেখলাম আজ আর একটা নয়, একটা আলপিন আর একটা কালকের পেরেকের সেজ ভাই এর বয়সি পেরেক। মনে হল আমার সময়টা ববি দেওল-এর থেকেও ফ্লপ যাচ্ছে। একেওকে জিঞ্জেস করে কাছাকাছি একটা দোকান পেলাম। পরীক্ষা শুরুর আগের মুহূর্তের প্রার্থনা নেমে এল আমার চোখে। হে ভগবান টিউবটা যেন টিকে থাকে, কালকেই পাল্টেছি। হ্যাঁ, আজকেও। আলপিন, পেরেক কি আর একসাথে সামলাতে পারে ভার্জিন টিউব। ফর্দাফাঁই। পাংচার সারানোর লোকটা বলল ‘নতুন টায়ার তো’ ? আমি হ্যাঁ এর দিকে মাথা নাড়ালাম। লোকটা তারপর বলল ‘নতুন টায়ারের সাথে পেরেকের সম্পর্কটা খুব ভাল বুঝলেন। নতুন টায়ারে যে চিটটা থাকে সেটা পেরেককে একটু পেলেই ভেতরে টেনে নেয় বুঝলেন। একটু পুরনো হয়ে গেলে আর টানবে না বুঝলেন’। এই শুনে আমি স্বার্থপরের মতো নতুন টায়ারের সাথে পেরেকের সম্পর্কে নজর দিয়ে দিলাম।
কবে যে পেরেকের সাথে টায়ারের শারীরিক সম্পর্কটা শিথিল হয়ে আসবে। সেদিন আর একটু টাচ পেলেই টিউব এর ভিতর পেরেককে ঢুকতে দেবে না টায়ার।
হাতবদল
আদিম যুগের মানুষ যখন হাতের ব্যবহার জানত না তখন জলাশয়ে মুখ লাগিয়ে জল খেত -- এটা পড়াতে গিয়ে আদিম 'আমি'টার কথা খুঁড়ে বের করলাম ভিতর ভিতর। এক হাতে গ্লাস ধরে কিছুতেই জল খেতে পারতাম না। ছোট্ট ওই হাতটার থেকে গ্লাসের সাইজটাকে অহেতুক বড় মনে হত। দু'হাতে ধরে জল খেতাম। আর গোপনে প্র্যাকটিস চালাতাম কি করে এক হাতে ধরে বড়দের মতো ‘হাঁ করে’ জল খেতে হয়। স্টেনলেস্‌ স্টিলের গ্লাস পিছলে যেত, মাটিতে পড়ে ‘ঠং ঠংঠং ঠং’ ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক দিয়ে বুঝিয়ে দিত আমার ছোট হয়ে থাকার ব্যার্থতা। রাগদুঃখক্ষোভে জলই খেতাম না অনেকক্ষণ। ভাবতাম যেদিন কলসি থেকে জল গড়িয়ে এক হাতে একা একা খেতে পারব ঠিক সেদিন থেকে আমি বড় হয়ে যাব—আমার হাত দু’টো আরো একটু বন্ধু হয়ে উঠবে আমার।
তারপর কবে থেকে যেন আমিও পারতে লাগলাম। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে বেশি বেশি জল খেতে থাকলাম।
আদিম যুগের মানুষও একদিন তাদের হাতের ব্যবহার শিখল। আঁজলা করে তুলে নিল জল। তারপর শুধু ইতিহাস বইতেই সভ্য হল তারা। হাতের ব্যবহার ডেভলপ্‌ করতে করতে মানুষ ‘হাত মারতে’ও শিখে গেল। এত কিছু হাতের ব্যবহারের ভিড়ে; প্রয়োজনে আর একটা মানুষের হাত ধরতেই ভুলে গেল। উন্নত মানুষের হাতের ব্যবহার তার ব্যবহারের হাতটাকে ভোঁতা করে দিতে থাকল ক্রমশ..
ভ্রুউউউম
বিকেলের আলোটুকু আরও একটু বেশিক্ষণ টিকে ছিল আজ মেঘ মেঘ আকাশের ভেজা ঠোঁটে। টুম্পাদিদিকে গাড়ি চালানো শেখাবো বলে। টুম্পদিদির একটা নতুন স্কুটি হয়েছে, টুম্পাদিদির মতোই ফর্সা দেখতে গাড়িটা। বিকেলে শান্তিনিকেতনের রোগা রোগা রাবীন্দ্রিক রাস্তাগুলোতে নেমে এসেছিল আজ আমাদের কোচিং ক্লাস। তারপর যখন ফর্সা স্কুটিটা একটুএকটু শিখে যাওয়া আবহাওয়ার সাইন্ড নিয়ে টুম্পাদিদির সাথে আমার নাগালের বাইরে যেতে থাকল ।আমি 'গর্বিত' অভিভাবক এর মতো একটা নিশ্চিন্তির সিগারেট ধরিয়ে একটু ফ্ল্যাশব্যাক ডাকলাম। মনে পড়ল আমাকে কেউ কোনোদিন হাতে কলমে বা পাশেপাশে দৌড়ে বা পিছনে স্পিকারের মতো বসে বাইক চালানো শেখায়নি। ছোটবেলায় বড়মামা আর মেজমামা যখন স্কুটার নিয়ে আমাদের বাড়ি আসত আমি ছুট্টে গিয়ে গাড়িটার উপর চেপে মুখে ভ্রুউউউমম করে চালাতাম। স্কুটারটা ডব্‌ল স্ট্যান্ড এ থাকত বলে পরে যেত না, যেভাবে সরকারি চাকরির জীবন নিশ্চিন্তে ডব্‌ল স্ট্যান্ডে থাকে; হুট করে পড়ে যাওয়ার সম্ভবনা থাকে না। দাঁড়িয়ে থাকা স্কুটারটাই শুধু কায়দা কৌশলগুলো করে কতকত দূরদূর ঘুরে আসতাম ওই ভ্রুউউউমম করে। একদিন মেজমামা স্কুটারের চাবিটা দিয়ে বলল 'চালা তো দেখি'। তখন কিসেই বা পড়ি আমি;সিক্স-সেভেনে হবে--এবং আমি স্কুটারে স্টার্ট দিয়ে চালিয়ে দিলাম, গিয়ার চেঞ্জ করে ক্ল্যাচ ছাড়তে গিয়ে একবারও স্টার্ট অফ হলো না। তারপর মিলিয়ে যাওয়া আমি টা যখন আস্তে আস্তে স্পষ্ট হচ্ছি স্কুটারটা নিয়ে দেখলাম মা রাস্তায় বেরিয়ে চলে এসেছে। সেদিন আমি অনেকটা বড় হয়ে গেলাম দুম করে। তারপর ক্লাস এইট এ পড়তেপড়তে আমাদের ঘরে 'হামারা বাজাজ' এল। একটা লালটুকটুকে m80। বাবার প্রথম গাড়ি। এবং তখনও অবদি বাবা চালাতে জানে না সেটা, আমি কিন্তু জানি। m80 টা নিয়ে যখন প্রথম বেরোলাম বড় রাস্তায় মনে হল গাড়ি ব্যাপারটা 'বাপের' বা নিজের হওয়াটা খুব জরুরি, অন্য কারোর চালিয়ে সেই হাওয়টা যেন গায়ে লাগে না। এখন আমায় রোজ ৮০-৮৫ কিমি আমার বাইকটা চালাতে হয়, ক্লান্ত লাগে। সিগারেটটা ফুরিয়ে এল যখন ফ্ল্যাশব্যাকটা সুইচ অফ করতেই দেখলাম ওই তো স্কুটিটা নিয়ে ফিরে আসা টুম্পাদিদি স্পষ্ট হচ্ছে আমার চোখে। দেখতে দেখতে আমার সেই ভ্রুউউউমম গাড়ি গাড়ি খেলার উত্তেজনার গায়ে জমে থাকা ধূলোতে একবার ফুঁ দিলাম আজ।
চারআনা রস
আইইইসক্রিম-আইইইসক্রিম-আইইইসক্রিম, এর থেকে টানের ‘নিশির ডাক’ আমি শুনিনি জীবনে। তখন ভাবতাম যেদিন আমি আমার নামটা লিখে একটা ‘সই’ করলেই ব্যাঙ্কের ওই ছোটদের হাতের মাপের ফাঁকটা থেকে বড়দের একটা হাত টাকা বাড়িয়ে দেবে —সেদিন আমি গোটা গাড়িটা কিনে নেব, গাড়িটা না ; গাড়ির ভিতরের সঅঅঅব আইসক্রিম গুলো। সব্বাই মিলে গোল করে বসে চুষেচুষে চেটেপুটে খাব জিভের শীত। বড়রা বলত জল মালাই আইসক্রিম বড় বড় ড্রেনের জল দিয়ে তৈরি হয়, ওটা খেতে নেই। চারআনা দাম ছিল সেই স্বর্গীয় সুখের জলমালাই আইসক্রিমের। তাই পকেটে একটা চারআনা থাকলেই হাঁটাচলা বদলে যেত পায়ের। চারআনা পয়সাটা হয়ত সেই বড়বড় ড্রেন দিয়ে ছোট ছোট মানুষের গল্প নিয়ে বয়ে যেতে যেতে হারিয়ে গেল...

ঘুঁটের মেডেল

এক পোন ঘুঁটে ক’টা ? দামই বা কত ? নাঃ; সামনের এসএসসিতে আসবে না, মাষ্টার মাইন্ডেও ঝকঝকে ব্লেজারে ফেস করতে হবে না এই প্রশ্ন। কিন্তু ওই যে, জীবন তো জী বাংলার বাইরেও একটু আধটু ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আমার বেড়ে ওঠার সময়েই এই বোলপুরে যত্রতত্র ঘুঁটে দেওয়া দেওয়াল দেখেছি। এখন যেমন দেবের ছবির পোষ্টার। আর মেডেল শব্দের সাথে পরিচয় আমায় প্রথম ‘ঘুঁটেরমেডেল’ কথাটাই করায়। কিন্তু মা যে কি যত্নে; কেনা ঘুঁটেগুলোকে সামলে রাখত যাতে বর্ষাকালে ভিজে গিয়ে তার ভিতর উৎসাহের আগুন ফুরিয়ে না যায়—সেই জন্য ঘুঁটেকে আমার কোনোদিন অতটাও ফ্যালনা মনে হয়নি। বরং অবসরে প্রিয় খেলনা হয়ে উঠত সে। জোগাড় করে আনা কাঠের যখন ভিজে জ্বর চলে আসে, আর জ্বলতে পারে না—তখন মুখনিচু ঘুঁটে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসে, ভাতের হাঁড়ির কাঁধে হাত রাখে—ভাতের জল ফোটে। অনেকটা সেই বন্ধুটার মতো যে আড্ডায় থাকলে মনেই থাকে না তার প্রেজেন্স, অথচ না থাকলেই কি প্রকট হয়ে ওঠে তার অনুপস্থিতি।
এখন যখন ফোটোশপে চুবিয়ে আনা ঝকঝকে ঘুঁটে দেওয়া দেওয়ালের ছবি দেখি—দেখি গরিবির গ্ল্যামার তুলে আনার তুমুল চেষ্টা, তখন ওগুলোকে আর ঘুঁটে লাগে না। মনে হয় সত্যিই কষ্টের মেডেলগুলো পরপর সাজানো রয়েছে বুকে আঙুলের ছাপ নিয়ে।
এক পোন ঘুঁটে ক’টা ? দামই বা কত ? ধুর...তার থেকে চেন্নাই এক্সপ্রেসের বাজেট অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক।

No comments

Powered by Blogger.