বীরভূমের অতীত রাজধানীতে একদিনঃ অমিতাভ ঘোষ
অমিতাভ ঘোষ
হঠাৎ করেই সুযোগ চলে এলো বীরভূমের অন্যতম ঐতিহাসিক কেন্দ্র রাজনগর দর্শনের। ঠিক হলো অপূর্বদার
গাড়ীতে আমরা চারজন যাব। বীরভূমের একসময়ের রাজধানী রাজনগর এখনো পর্যটনকেন্দ্র
হিসাবে গড়ে উঠতে পারেনি। তাই সমস্যা হলো আমাদের সঠিকভাবে গাইড করবে কে ? কিন্তু
যখন শুনলাম আমাদেরকে পূর্বসূরীদের রাজ্যপাট দেখাবার জন্য রাজী হয়েছেন বর্তমান
রাজাসাহেব রফিকুল আলম খানের পুত্র সফিউল আলম খান, আমি রাজনগর দর্শনের লোভ সামলাতে
পারলাম না। রাজকুমারের সাথে ঘুরে ঘুরে তাদের ঐতিহ্যের ইতিহাসের সাক্ষী হওয়া ! এমন সুযোগ কেউ ছাড়ে নাকি ?
বীরভূম জেলার বর্তমান রাজধানী তথা সদর শহর হলো সিউড়ি। এখান থেকে অতীতের রাজধানী
রাজনগর প্রায় ২৫ কিমি দূরে। আমাদের যাত্রা শুরু সিউড়ি থেকে। ৬০ নম্বর জাতীয় সড়ককে
লম্বভাবে অতিক্রম করে আমরা এগিয়ে চললাম। কিছুক্ষণ যাওয়ার পর বাঁদিকে দেখতে পেলাম
বিখ্যাত সতীপীঠ বক্রেশ্বর যাওয়ার রাস্তা। সিউড়ি থেকে যতই পশ্চিমে যাওয়া যায় ততই
লালমাটির রুক্ষতা কমে গিয়ে সবুজের আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। এইদিককার প্রাকৃতিক দৃশ্য
চোখ জুড়ানো। অবশেষে আমরা একটি আধাশহরে এসে উপস্থিত হলাম। এটাই অতীতের রাজধানী
রাজনগর।
একসময়ের
রাজধানী এই রাজনগরে দীর্ঘদিন ধরে রাজত্ব
করেছেন প্রথমে হিন্দু ও পরে মুসলিম
রাজারা। ইতিহাস থেকে জানা যায় সেন বংশের রাজা বল্লাল সেন মিথিলা জয় করবার সময় তার
পুত্র লক্ষ্মণ সেনের জন্মসংবাদ পান। সেই সময়ে তিনি বর্তমান রাজনগরের জঙ্গল পরিবেষ্টিত
স্থানে দুর্গ নির্মাণ করান ও পুত্রের নামানুযায়ী
এই স্থানের নাম দেন “ লক্ষ্মনোর” ।পরে “লক্ষ্মুর”
ও তারপরে “নাগর” বা
“নগর” নামে পরিচিত হয়। পরবর্তীকালে হিন্দু
রাজা বীর সিংহ ও চৈতন্য সিংহ এই স্থানে রাজধানী স্থাপন করেন। তখন থেকেই ‘রাজনগর’ বীরভূমের রাজধানী হিসাবে পরিচিত। পরবর্তীকালে পাঠানবংশীয়
আসাদুল্লা খাঁ ও জুনেদ খাঁ হিন্দুরাজাদের হাত থেকে রাজত্ব ছিনিয়ে নিয়ে মুসলমানরাজত্বের
সূচনা করেন। এই জুনেদ খাঁ’য়ের পঞ্চম পুরুষ
হলেন বদিউজ্জামান খাঁ। তিনি নবাব মুর্শিদকুলী খাঁ’এর নিকট হতে “রাজা” উপাধি লাভ
করেছিলেন। রাজা বদিউজ্জামানের পুত্র রাজা আসাদুজ্জামান খাঁ’ই হলেন বীরভূমের শেষ শাসনকর্তা।
আমাদের বর্তমান রাজা মহম্মদ রফিকুল আলম খান সম্ভবত আসাদুজ্জামানের ষষ্ঠ পুরুষ।
আমাদের গাইড সফিউল বর্তমান রাজার পুত্র।
গাড়ী থেকে নেমেই পরিচয়
বিনিময় হলো সফিউলের সাথে। শান্ত, ভদ্র সফিউলের শরীরে রাজপরিবারের আভিজাত্যের
নীলরক্ত বইছে সেটা তার সাথে কথা বললেই বোঝা যায়। অত্যন্ত বিনয়ী এই রাজপুত্র
সাহিত্যচর্চা করতে ভালোবাসেন। বয়সে ছোট সফিউল অল্প সময়েই আমাদের বন্ধু হয়ে উঠল। আমরা এবার তাকে অনুসরণ
করতে লাগলাম। রাজনগরের বর্তমান রাস্তা বেশ অপরিসর। সেই রাস্তা দিয়ে কিছুটা
এগিয়ে আমরা ডানদিকে পেলাম বিশাল এক খোলা জায়গা, মাঠ
বললেই ভালো হয়। দূর থেকেই দেখা যায় সাদা রঙের ইমামবাড়া। সিঁড়ি দিয়ে উপরে
উঠে অনুভব করলাম এই রাজকীয় স্থাপত্য। চওড়া দেওয়াল, অনেকটা জায়গা নিয়ে এই ইমামবাড়া।
এর পাশেই বিশাল জলাশয়, নাম ‘কালীদহ’। কালীদহের দক্ষিণে রাজপ্রাসাদের ধবংসাবশেষ আজও লক্ষ্য
করা যায়। এই জলাশয়ের মাঝে দ্বীপের মতো একটি জায়গা আছে। সেখানেই ছিলো অতীতের
হাওয়ামহল। উড়িষ্যার স্থাপত্যের অনুকরণে স্থাপিত এই মহল। বর্তমানে লতাগুল্ম পরিবেষ্টিত
হয়ে জীর্ণ অবস্থায় ইতিহাসের সাক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়ে। মারাঠা আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য অতীতে রাজনগর সুদীর্ঘ ৩২ মাইল দীর্ঘ উঁচু প্রাচীর দিয়ে পরিবেষ্টিত ছিল। আমরা এগিয়ে এলাম রাজপ্রাসাদের কাছাকাছি। দেখলাম কালীদহের দক্ষিণ পাশে প্রাচীন সেই গাব গাছটিকে, যেখানে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিলো মাংলা মাঝিকে। এই
গাছ আজও সাঁওতাল বিদ্রোহের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। এই জায়গা থেকেই একে একে দেখে
নিলাম রাজপ্রাসাদ লাগোয়া বারুদঘর, ফাঁসিঘর। ভগ্নপ্রায় এই ঘরগুলির সামনে দাঁড়ালে
আজও গায়ে কাঁটা দেয়।
একটু বিশ্রাম। আরো একটু অতীতের গল্পশোনা। একটু
হেঁটে পৌঁছালাম ‘হামাম’-এ। রাজপরিবারের বেগমদের স্নানঘর। এখনো দেখে মুগ্ধ হতে হয়।
অতীতের বিশেষ প্রযুক্তিতে কালীদহের জল পৌঁছাতো বিলাসবহুল হামামে। সেখানকার পরিবেশ
শীতল ও সিগ্ধ রাখার কৌশলও ছিলো এই বিশেষ ব্যবস্থায়। আজও চলছে এই নিয়ে বিস্তর
গবেষণা।
সবশেষে পৌঁছালাম
মোতিচূড় মসজিদে। এই জায়গায় প্রবেশপথেই বামদিকে এই বিখ্যাত মসজিদ। যদিও এই মসজিদ
‘আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া’র অধীনে আছে কিন্তু তাও ঠিকমত সংরক্ষিত নয়।
টেরাকোটার মন্দির আমরা অনেক দেখতে পাই কিন্তু মসজিদ খুব একটা দেখা যায় না। সেইদিক
থেকে দেখলে বিরল এই মসজিদ; টেরাকোটার অসাধারণ সাজে সাজানো। সমগ্র মসজিদের গায়ে
টেরাকোটার কারুকার্য আজো মুগ্ধ করে আমাদের। এখানকার টেরাকোটা আয়তাকার। টেরাকোটার
জন্য বিখ্যাত জায়গা বিষ্ণুপুর থেকে শিল্পী ও কারিগর এসে সাজিয়ে তুলেছিলেন এই মসজিদ। এখানে পাঁচটি প্রবেশদ্বার দেখা গেলেও
তিনটি সত্যিকারের প্রবেশদ্বার ও দুটি নকল। ঠিক আমরা যেমন দেখি মুর্শিদাবাদের
হাজারদুয়ারী’তে।
আধাশহর আধাগ্রাম হিসাবেও
বর্তমান রাজনগর বেশ সুন্দর। ঘুরতে ঘুরতে মনে হলো আজও এই জায়গায় অতীতের রাজশাসনের চোরাস্রোত বইছে। আজও এখানকার মানুষের
ভালোবাসার চাপে রাজা রফিকুল আলম খানকে রাজবেশে সজ্জিত হতে হয়ে দাঁড়াতে হয় মহরমের
তবা আসুরার দিনে। এখনো রাজবাড়ী সংলগ্ন ইমামবাড়ায় প্রতিবছর মহরমের শোভাযাত্রার
সূচনা হয় এক দিন কা এই রাজার অঙুলীহেলনে !
আরো কী কী দেখবেন – দেখে নিতে পারেন
রাজনগর থেকে কয়েক কিমি দূরে তাঁতলোই এর উষ্ণপ্রস্ববন। এছাড়া গ্রীষ্মকালে এলে
রাজনগরের কয়েক কিমি দূরে অতীব সুন্দর আম বাগান দেখে নেওয়া যাবে। এখানে নিজে হাতে
করে গাছ থেকে আম তুলে কিনে আনা যায়। এছাড়া
সিউড়ি থেকে রাজনগর যাওয়া আসার পথে দেখে নেওয়া যায় সতীপীঠ বক্রেশ্বর ও দাতাবাবার পাথরচাপুড়ি।
ছবিঃ লেখক
লেখাটি ভালো লাগলো। ছবিগুলি বিশেষভাবে আকর্ষক!
ReplyDelete