দেবারতি মিত্রের 'ফুল গাছে যক' কবিতার আলোচনাঃ কবি অনুরাধা বিশ্বাস






ফুল গাছে যক / ভুতেরা ও খুকি / দেবারতি মিত্র


সাতষট্টি বছরের পরে আর এখন বছর নেই,
তবু লোভ, শুধু লোভ ঐ কাঞ্চনফুলের গাছ
থোপা থোপা সাদা, বোধ হয় জন্মের ও আগে,
মনে আসতে গিয়ে আসতে চায় না
অমনি ছিল আমার মা
বলিস নি, কাঞ্চন গাছ ছাড়তে বলিস নি আমাকে

নিরতিশয় সামান্যতার সাথে যে নিবিড় বন্ধন আমাদের একটি ফুলগাছের মতই আমাদের হৃদয়দৌর্বল্যগুলিকে তা সস্নেহে লালন করে চলেছে। যেন অতি পুরাতন যক্ষ কোনও তার সরলতম অপ্রাপ্তিটির ক্ষোভে পুরনো সুখ দুঃখের একখানি ঢিল আমাদের রুমালে বেঁধে দিয়েছেন। ফিরে দেখার সুখে ফিরে না পাওয়ার ব্যাথা। মনের ভিতরে কি প্রকান্ড এক দানবের বাসা, তার বেদনার সুধা চাই, চাই প্রাপ্তির আস্কারা। সুধীর বামনের ভূত বহুকাল ইহলোকের রশি ছিন্ন করে কাঞ্চন গাছটির প্রতি একনিষ্ঠ। সৎ স্বচ্ছ পুরুতঠাকুর, তার পরিবার, হাজা পায়ে আলতা থেবরানো সরল অপরূপখানি, সন্তানাদি – পুরনো ভ্যাপসাগন্ধ গীতা নিয়ে তার সাতষট্টি বছরের পূর্বজীবন, অন্যদুনিয়া থেকে তিনি দ্যাখেন এসমস্ত ফুটে রয়েছে থোপা থোপা কাঞ্চন ফুলে। এখন মিশনারি স্কুল সেইখানে, নীলচোখা পাদরি সাহেবের সাদা উনিফর্মে, ঈশ্বরপ্রার্থনায় করুনার মেঘ উড়ছে। ফুল গাছের যক তবু পূর্বজীবনের জীবাণুখানি জিইয়ে রেখেছেন, বাঁচিয়ে রেখেছেন তার পিপাসা আর প্রাণটিকে, বৃষ্টির ভিতরে বৃষ্টি হয়ে মিশে যাওয়ার আরাম-কল্পনাকে।  এইসবই মনে হল কবিতাটি ফিরে পড়ে, বহুদিন বাদে। মুরাকামি IQ84 উপন্যাসে এক চরিত্রকে দিয়ে বলিয়ে নিয়েছিলেন – ‘But don't let appearances fool you. There's always only one reality’ আর তার অব্যবহিত পরেই অন্য পৃথিবীতে চলে এসেছিলেন চরিত্রেরা, তাদের গল্প, লেখক নিজেও সুধীর বামনের মত আমাদেরও একাধিক পৃথিবী রয়েছে, সময়ে অসময়ে চকের রেখা তুলে ফেলে আমরা মিশিয়ে ফেলি পৃথিবীগুলিকে তখন জানালার কাচে অতীত মুখ গতকালের মত স্পষ্ট হয়ে পড়েসুরঞ্জনের ভাইকবিতায় কবি মনে করিয়েছেন
যতই টি হোক তবু এই পৃথিবীতে
একটা প্রকৃতি আছে, আছে নির্গলিত কালো সাদা,
কিন্তু পরলোক সে যে অস্বচ্ছ বিষমকোণ-
বাধা, মায়া, ঈর্ষা, উন্মাদনা,
অকাতর মেঘের ওপারে উঠে চলে গেলে, প্রত্যন্ত কুয়াশা

সেই কুয়াশাচ্ছন্ন বিষমকোণ হতে পুরাতনের নোঙরে আটকে থাকা সুধীর বামন ফ্যানি ব্রাউনের টুপি জলে ফেলে দেন, আঁকশি হাতে হাসু তার বাস্তবটুকু, ভোরের বাতাস, পরিচিত সবুজ ছাড়া দেখতে পায়না কিছুই কবিতাটিতে, একটি ভূতের গল্পের ভিতরে আমাদের হৃদয়ের সামান্যতা পড়ে রয়েছে। যা কাঞ্চন ফুলের সাদা রঙের মত। সরল, একনিষ্ঠ দুঃখের দেবতা, দুঃখের দানব তা অতিক্রম করতে পারে না। এই অনতিক্রম্যতাই কি আমরা লালন করি না আর্কাইভের স্তূপের ওপর বসে। কবিতার শেষ দুলাইন
‘অমনি ছিল আমার মা
বলিস নি, কাঞ্চন গাছ ছাড়তে বলিস নি আমাকে
মা-এর অতীতচারিতা কবির ব্যক্তিগত স্মৃতি, কবির অতীতচারিতা এমন অনুভূতি ব্যক্তিগত বলেই বোধ হয় শাশ্বত হৃদয়ের পীড়াআমাদের শরীরি ব্যাথা বেদনার মতই বর্ণনাতীত অধিকাংশ সময়ে, তবু তা সকলেরই হয় বলে এক-দুটি শব্দে আমরা তা প্রকাশ করা অভ্যেস করতে পেরেছি এসবই মনে হল, এসমস্ত নিতান্তই পাঠকের অনুভূতি, যারা অপেক্ষায় ছিল, কবিতাটি খানিক উস্কে দিয়েছে। অসামান্য কবিতাটি নীচে রইল –

অনুরাধা বিশ্বাস
কলকাতা, এপ্রিল, ২০১৭




No comments

Powered by Blogger.