বিকনা : ডোকরা গ্রামে কাটানো একদিন।
লিখছেন অরিন্দম মণ্ডল |
গ্রাম বাংলার লোকায়ত শিল্পের একটি “ডোকরা”। বহু বছর আগে আমি যখন ছাত্র,থাকি শান্তিনিকেতনে বিদ্যাভবন বয়েজ্ হস্টেলে, তখন প্রথম পরিচয় এই ডোকরার সাথে। পৌষ মেলায়। সেদিন যে মানুষজন সেগুলো বেচ ছিল ,আর যা শিল্প কর্ম চোখের সামনে থরে থরে সাজানো ছিল,দুটোকে মেলাতে হিমশিম খাচ্ছিলাম! ডোকরার প্রতি ভালোলাগা আর বিস্ময়ের সূচনা তখন থেকেই।
শিল্প আমি খুব একটা বুঝিনে, তার জন্যে আলাদা স্কুলিং লাগে, যা আমার নেই। তবে এটা বেশ বুঝি, যে মানুষ নিজের হাতে কিছু সৃষ্টি করে অন্যকে স্তব্ধ করে দেয়,সামনের জন যতই আত্ম গরবে মগ্ন হননা কেন, তাকে আচমকা নিজের প্রতি কুণ্ঠিত হতে বাধ্য করে এবং তার মনে বিস্ময় ও সমীহ জাগায়, তারা ঈশ্বরের থেকে কম কেউ নন। আমার মত নাস্তিকের কাছে শিল্পীরাই ভগবান । তাই বহুদিন থেকে ইচ্ছে ছিল এই মানুষ গুলোর কাছে কিছু সময় কাটাই। আর চাক্ষুষ করি এই অসামান্য শিল্প সৃষ্টিকে। সেই ইচ্ছে থেকেই দিন কতক আগে পৌঁছে গেলাম বাঁকুড়ার উপকণ্ঠে বিকনা গ্রামে।
গ্রামে মেরে কেটে গোটা চল্লিশেক ঘর। আর প্রতিটি ঘরেই বাচ্চা থেকে বুড়ো নিরলশ সৃষ্টিতে মশগুল। এখানে সবার পদবিই “কর্মকার”। ঘুরতে ঘুরতে পরিচয় হল বৃদ্ধ অমর কর্মকারের সাথে। বয়স ছেষট্টি।
( ইনি অমর কর্মকার)
তাঁর মুখ থেকেই শুনলাম তাঁদের জীবন জীবিকা আর পূর্ব পুরুষদের কথা। বিকনা গ্রামের কর্মকাররা এসেছে আট -ন’ পুরুষ আগে। তবে তাদের যাত্রা শুরু হয়েছে হাজার বছরেরও বেশি আগে । তাদের অরিজিন হল মধ্যপ্রদেশের বস্তার। আগে তারা যাযাবর জাতি ছিল। ডোকরার জিনিসপত্র সম্বল করেই তারা গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়াতো। যে অঞ্চলে যেত ,তার আশেপাশের বনভূমি সংলগ্ন এলাকায় তারা অস্থায়ী ডেরা বাঁধত। কারণ ডোকরার প্রধান উপকরণ মোম আর ধুনো। এই মোম তারা জঙ্গলে ঘুরে মৌচাক থেকে সংগ্রহ করত। আর ধুনো শাল গাছের আঠা থেকে বানাতো। এছাড়া এখন সর্ষের তেল লাগে। তখন মহুল থেকে তৈরী তেল ব্যবহার হত ।সেটাও আনা হত ঐ জঙ্গল থেকে। আর ভাটির জন্যে তখন কয়লার বদলে কাঠ ব্যবহার হত। সেই জ্বালানী কাঠও সংগ্রহ হত এভাবেই। এখনকার দিনে ভাটি থেকে জিনিস বের করতে বিরাট বিরাট সাঁড়াশি ব্যবহার হয়। কিন্তু প্রাচীনকালে সাঁড়াশি ব্যবহার হতনা। তারা কাঁচা বাঁশ কেটে তাতে তার দিয়ে লম্বা লাঠি বেঁধে কাজ চালাতো।
।
বানানো জিনিস তারা ঝুড়িতে ভরে মাথায় চাপিয়ে আশেপাশের গ্রামে বেচতে যেত। কিছু সময় পর আবার তল্পিতল্পা গুটিয়ে যাত্রা শুরু,,,নতুন মানুষ, নতুন দেশ, নতুন করে ঘর বাঁধা, নতুন করে বিকিকিনি ! এমনি করেই তারা বস্তারের থেকে ঝাড়খণ্ড,ওড়িষ্যা, পুরুলিয়া, মেদিনীপুরে ছড়িয়ে পড়ল। পুরনো সমাজ ব্যবস্থায় রাজা-জমিদাররা যখন নতুন নতুন গ্রাম বানাতো, তখন সেখানে নিত্য প্রয়োজনীয়তার কথা মাথায় রেখে ব্রাহ্মণ, ধোপা, নাপিত, কুমোর--- এদের এক দু’ ঘর করে এনে বসাতো। জমি দিত। একই ভাবে ডোকরা কারিগরদেরও এই ভাবে কোথাও কোথাও পাকাপাকি ভাবে বসানো হয়। তারপর থেকে তারাও ভবঘুরে জীবনে দাঁড়ি টেনে থিতু হতে থাকে। শুরুতে তারা আদিবাসীদের জন্য পায়ের নুপুর, হাতের বালা ,গলার হাঁসুলি, মাথার কাঁটা এবং আরো গয়নাগাটি বানাতো। পরে অন্যান্য গ্রাম্য সভ্যতার সংস্পর্শে এসে লক্ষ্মীর সাজ, প্যাঁচা, গণেশ,ইঁদুর, ময়ূর ,ঘট, বাক্স , শস্য মাপার পাই ইত্যাদি বানাতে থাকে। আবার দৈনন্দিন জীবনের নানা কথাও মূর্ত হতে থাকে তাদের হাতে।
( সপরিবারে,হাতে হাত ধরে )
এবার আসি বানানোর পদ্ধতিতে : বানানোর প্রাথমিক উপকরণ ধুনো, মোম আর সর্ষের তেল পরিমাণমতো মিশিয়ে একটা নরম মণ্ড তৈরি হয়। এর সাথে কিছুটা পিচও মেশানো হয়। যদি 01 kg ধুনো নেওয়া হয়, তাহলে মোম লাগে 1.5 kg আর তেল লাগে 250 gm.
ছবিতে যে কালো অংশ দেখাচ্ছে, সেটি ধুনো, মোম ,তেল আর পিচের মিশ্রণে তৈরি। এটি দিয়ে প্রাথমিক মডেলটি তৈরি হয়। কালোর ওপর যে হলদেটে নকশা রয়েছে,সেটি আগুনে হালকা হালকা করে গরম করে সুতোর মত সরু সরু মোম দিয়ে বানানো হয়। এরপর পাতলা দোঁয়াশ মাটি দিয়ে গোটা মডেলটি ঢেকে শোকানো হয়। তারপর সেটির চারপাশে পুরু করে বেলে মাটির আস্তরণ দেওয়া হয়। এই পর্বে ধুনো-মোমে তৈরি মূল মডেল অবধি মাটির ভিতর দিয়ে দুটো ছিদ্র পথ করা হয়।
এমনি করে একটি ভাটিতে ধরানোর মত যথেষ্ট মডেল বানিয়ে শুকনো করা হয়। যেদিন “ভাটি করা” হবে সেদিন ভোর থেকে ভাটিতে পঞ্চাশ কেজি কয়লা দিয়ে আগুন ধরিয়ে মডেল গুলো পোড়ানো শুরু হয়। তাপের চোটে মডেলের ভেতরের মোম-ধুনো ছিদ্র পথ দিয়ে গলে বা, ভাপ হয়ে বেরিয়ে আসে। কিন্তু মডেলটি তৈরির সময় প্রথমেই যে পাতলা মাটি দিয়ে পরত দেওয়া হয়েছিল, তাতে মূল নকশা ধরা থেকে যায়। এবার যে পথে মোম গলে বেরিয়ে গেছিল,সেই পথে গলিত পেতল ঢালা হয়,যা ধুনো-মোমের শূন্য স্থান দখল করে। এরপর ঠাণ্ডা হলে মাটি ভেঙে জিনিসটি বের করা হয় এবং প্রয়োজনমতো পালিশ করে নেওয়া হয়।
(এই ভাটিতেই পুড়ে রূপ পায় শিল্প সৃষ্টি)
মোদ্দা কথাটা হল কাজটি অত্যন্ত ধৈর্য এবং পরিশ্রম সাপেক্ষ। পদ্ধতি জটিল। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী আছে, শিল্প যদিবা কখনো সখনো দাম পায়,শিল্পীর দাম কেউ দেয়না,,,,অন্তত এই পোড়া দেশেতো ভুল করেও কাউকে করতে দেখিনা। ডোকরা শিল্পীরাও তার ব্যতিক্রম নয়। তারা অত্যন্ত দারিদ্র্যের সঙ্গে দিন গুজরান করে। এই প্রজন্মের শিল্পী রাধেশ্যাম কর্মকার খুব দুঃখ করে বলল : জানেন দাদা, আমাদের পরিশ্রমের কেউ দাম দেয়না, শিল্পী বলেও ভাবেনা। ….এখন যে অর্ডার আমরা পাই,তার বেশিরভাগই মর্ডান আর্টের। ডোকরার মূর্তিতে টানা চোখ, টিকালো নাক হয় না। এমনি করে পুরনো ঘরানাটাই হারিয়ে যাচ্ছে! ... নিজেদের কাজ যদি বাড়াতে হয়, পুঁজি লাগে। আর ব্যাঙ্কের কাছে গেলে লোন দিতে চায় না। ফলে মহাজনের কাছ থেকে বেশি সুদে ধার করতে হয়। । আবার যারা আমাদের একদিনের পরিশ্রম মাত্র দুশো টাকায় কিনে নিয়ে যায়, তারা সেটা বেচে বারোশো-পনেরোশো টাকায়,,,আমাদের কাজে তারা বড়লোক হয়, আমরা দাম পাইনা! বললাম: তাহলে কি তোমরা অন্য সব কাজের সন্ধান করছো ? মুখে তার সরল কাষ্ঠ-হাসি : না দাদা,,,জন্মে থেকে এই কাজটিই দেখে আসছি,,,,ডোকরা আমাদের রক্তে আছে,,,, আমরা এই কাজটাই পারি। অন্য কাজে মন লাগবেনা !
জানিনা আর কতদিন !!
Post a Comment