যে কবিতাকে কোনও ছাঁচে ফেলা যায় না
বেবী সাউ
কবিতা এমন এক দিগন্ত, যার মধ্যে সমস্ত
রঙ ঢুকে পড়ে। সেই রঙের মধ্যে, সেই দৃশ্যের মধ্যে যেমন থাকে দূরের ধোঁয়ার আকাশে উড়ে
যাওয়ার দৃশ্য, তেমন থাকে হয়তো প্রেমিক-প্রেমিকার আশাযাপনের কথাও। থাকে একটা একলা
বারান্দায় বসে থাকা কোনও এক শূন্য মনের মানুষের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকার গল্প।
আবার থাকে কোনও এক মিছিলের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা একজন আউটসাইডারের কথাও। একজন
কবি আদতেই এক চিরকালীন আউটইসাইডার। কিন্তু আউটসাইডারেরও রাজনীতি থাকে, দর্শন থাকে,
নিজের মনের ভিতরে ঢুকে পড়া সংকটগুলি থাকে, নিজের অস্তিত্বের সঙ্গে ক্রমাগত দ্বন্দ্ব
থাকে। সে হয়তো কিছুই করতে পারে না। তার কিছুই করার নেই। তার চারপাশ দিয়ে বয়ে যায়
একটা অদ্ভুত সময়। একটা নৃশংস পলিটিকাল সার্কেল যেন। হিংসা, দ্বেষ, প্রতিহিংসা, ধর্মের এক বিচিত্র
ক্যাকোফনি। সাধারণ মানুষ শুধু ভোগে। ভোগ
করতে পায়না। ঠিক যেন চোখের সামনে আঙুরের গুচ্ছ তুলে ধরা হয়েছে। দেখো। হাসিলের
চেষ্টা করতে করতে দিনরাত কাটাও। অথচ, নাগাল
পাবেনা কোনমতেই। উন্নত মস্তিষ্কের কার্যকারণ পদ্ধতি। জয়ের পদ্ধতি। আর যেহেতু
সাহিত্যটা সমাজের বাস্তবচিত্র তাই এর প্রভাব গাঢ় ভাবে পড়ে তার ওপর । কার্য আর কারণ
এখানে ওতপ্রোতভাবে জড়িত বলে রাজনীতির সূক্ষ্ম কৌশল জনগণের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এর
প্রভাব পড়ে দেশের অর্থনৈতিক ভিতের ওপরে। আর এটা বোঝা যায় যখন অন্য সরকারের মাথায়
হাত। লুটেপুটে নিয়ে কেটে পড়া সরকার ততদিনে পগারপার। বিশেষত দেখা যায় আমাদের দেশে
বাজেট পদ্ধতিটাও একটা পলিটিক্যাল স্টেপ। সরকারের রোজনামচা পাবলিকলি দেখানোর উত্তম
প্রয়াস। যাতে দেখা যায়, কিছু
করি না করি একগাদা, গাদাগুচ্ছের
প্রকল্প তুলে ধরতে পারি। বলার সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারি । তখন সাধারণ মানুষদের
'অচ্ছেদিনের'
ভাবনায় ঢুকিয়ে দিয়ে;
নিজস্ব কাজ হাসিল করে কেটে পড়। সাধারণ মানুষের তখন
হাত কামড়ানো ছাড়া কিছু থাকে না। কিন্তু সাধারণের হাতে না আছে অস্ত্র,
সুবিধা, মিডিয়া
নাকি বলার মতো, প্রতিবাদ
করার মতো গর্জে ওঠার ভাষা। শুধু নির্বাক, নিস্তরঙ্গ
এবং ম্রিয়মাণ একটা জীবন ছাড়া যেন কিছুতেই কিছু নেই। হিন্দোল ভট্টাচার্যের কবিতা
গর্জে ওঠে না। কারণ, এই সময়ে একজন কবির প্রকৃতপক্ষে অসহায়তা ব্যক্ত করা ছাড়া আর
কিছুই করার নেই। আর এই কবি তো কবিতায় কোনও স্লোগান লেখার জন্য আসেননি, তাই তাঁর
রাজনৈতিক কবিতায় এক গোপন বিষাদ ঢুকে পড়ে। এই বিষাদের কারণ হয়তো অনেককিছুই।
আশ্চর্জনক ভাবে এই অনেককিছুর মধ্যে ঢুকে পড়ে রাজনীতি যেমন, তেমন কবির নিজস্ব এক
দার্শনিক যাত্রাপথও। সেখানে প্রেম থাকে, একা একা ঘুরে বেড়ানো থাকে, নির্জনতার
মধ্যে কবির বসে থাকা থাকে। একজন একাকী মানুষ হয়ে তিনি যখন বসে থাকেন, তখন তাঁর
রাগও তিনি বিড়বিড় করে বলেন। এই বিড়বিড় করে বলা কথাগুলিই হয়ে ওঠে কবিতা। যেমন-
"শুনেছি রাতের কাছে তুমিও ফিশফিশ
করে কথা বলে ওঠো---
আরেকটু আয়ুর জন্য যেভাবে সমস্ত প্রাণ
নিঃশব্দে তাকায়।
এইতো জীবন,
তাকে সংসার ভেবোনা।
অগোছালো করো।
এলোমেলো ঘুরে যাও নির্জন শীতের পাড়া
দিয়ে।
যখন সমস্ত ঝাঁপ বন্ধ হয়ে যায়,
আর
বাজারি কুকুরগুলো নেকড়ে হয়ে শোঁকাশুঁকি
করে;
এরকম রাতে
গৃহস্থ দুঃখের কথাগুলো আর নাই বা
শোনালে। " ( পাঠক )
হিন্দোল ভট্টাচার্য-এর "অনিবার্য
কারণবশত" কাব্যগ্রন্থটি আরম্ভ হচ্ছে এমন একটি কবিতা দিয়ে। আর তখনই রাত যেন
সত্যি সত্যি এমনই ভয়াল, ভয়াবহ
রূপের ভয়ে ভিখারি হয়ে ওঠে। যেমন আলোর জন্য হন্যে হয়ে একান্ত দুখী রাত। একটু আয়ুর
জন্য,
একটু বাঁচার জন্য,
বাঁচতে চাওয়ার জন্য আকুপাকু করে ওঠে আমাদের জীবন!
দয়া ভিক্ষা?
নাকি অধিকারের কথা বলে সে?
কিন্তু এই চাওয়াকে কবি তুলনা করলেন
"নিঃশব্দ" চাওয়ার সঙ্গে। 'বাজারি
কুকুর'? রাতের,শীতের
রাতের ভয়াবহতাকে যারা আরও ত্রাসের সৃষ্টি করে?
হিংস্র এবং ক্ষুধার্ত?
সেখানে মৃত্যু নিয়ে আয়ু নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করাটা বিচিত্র কিছুই নয়!
সনাতন দর্শনের দিকটি যদি দেখা যায়,
যদি আরেকবার ঝালাই করে নেওয়া যায় সেইসব শ্লোকের
কথাগুলি, তাহলে
দেখা যাবে--- 'ত্বমেব
বিদিত্বাহতি মৃত্যুমেতি' কিংবা
'জাতস্য হি ধ্রুবো
মৃত্যুঃ' অথবা
'ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ'
--- মৃত্যুর এই প্রহেলিকা বারবার ভাবিত
করেছে যুগযুগের সময়কে। মননকে। সামনের অজানা,
অচেনা অন্ধকার আমাদের পীড়িত করে,
ক্লান্ত করে তোলে। কবি হিন্দোল ভট্টাচার্য যেন
আবারও সেই হেরে যাওয়া ক্ষণের কাছে, সময়ের
কাছে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত
হয়েও সরে আসতে চাইছেন। পাঠক হয়ে উজাড় করে
নিতে চাইছেন বেঁচে থাকার শান্ত রূপটিকে। এখানে রাত ভয়াবহ নয়,
শান্ত, নিঃশব্দ। তাই যেন নিজের মনে বেজে ওঠে "এরকম
রাতে/গৃহস্থ দুঃখের কথাগুলো আর নাই বা শোনালে।" আবার এই কাব্যগ্রন্থটির অন্য একটি কবিতায় আমরা পাই,
জীবনকে, প্রেমকে
নতুন করে উপলব্ধির অনুভব। দেখি যেন ছেড়ে
যাওয়া, থেকে
যাওয়ার মধ্যেও একটা নিবিড় বোঝাপড়া কাজ করে।
"এভাবে হয় না পুজো;
কিছুতে হয় না।
গোলাপ,
চকলেট আর উদাসী তারিখ পড়ে থাকে।
একেকটি শহর ছোটে একেকটি মেলায়-
এভাবে হয় না গান,
বাঁশি বাজে দূরে।
তোমাকে গভীর থেকে ছুঁয়ে দেখি
কী বিষাদ লেগে আছে তোমার গোপনে।
সে বড় দু:খের কথা,-
চুপিচুপি গাছেদের ভালোবাসা লেগে থাকে
জানি।
যত সে নি:সঙ্গ তত প্রেম।
আলো আছে অল্প অল্প,
অন্ধকারও তত কড়া নয়।
ঘরে ঘরে বেজে উঠছে শাঁখ।
একা একা বাস ছাড়ছে রাতের ড্রাইভার।
আমরা দুজনে জানি
আছি।
আমরা দুজনে বুঝি,
এভাবে থাকার কথা ছিল না কখনো।" (
বসন্ত )
হিন্দোল ভট্টাচার্য-এর কবিতার মধ্যে
দেখা যায়, প্রেমের
কবিতার মধ্যেও ঢুকে পড়েছে দেশ, রাজনীতি।
অর্থাৎ বলা যায়, কবি
যেন তাঁর ব্যক্তিগত পরিসরেও এঁকে দিচ্ছেন তামাম দুনিয়ার চিত্র। কথা বলতে বলতে,
আড্ডা দিতে দিতে অরা যেমন বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে চলে
যেতে পারি মুহূর্তের মধ্যে, কবি
হিন্দোল ভট্টাচার্য এর কবিতা যেন সেভাবেই খুঁজে নিচ্ছে সমস্ত ঘটনার মধ্যে নিজস্ব
প্রেম, যাপন,
বসবাসকে। আর এই আসাটা এত স্বাভাবিক,
এত প্রাসঙ্গিক যেন এসব দৃশ্যকল্প,
এসব ঘটনা না এলে কবিতাটিই অধরা থেকে যেত। রাজনৈতিক
কবিতা প্রসঙ্গে আমরা দেখে নেব কাব্যগ্রন্থটির আরেকটি কবিতা---
" পরিত্যক্ত "
" কথা ছিল না তো কোনও আগুন শোনাবো
অনেক ধ্বংসের পাশে জেগে আছে অনেক
রাস্তাই
দেখ কত পলাশের ফুল কত প্রেম আজও করতলে
রাখা
শিবিরের খুব কাছে দাবানল ছুঁয়ে গেছে
বিপদসীমানা
যে ট্রেন বাতিল বহুদিন আজও
সেই ট্রেন মাঝরাতে আসে
বসন্তনির্ঘোষ শুনি রেডিওয় তবে এল
দেবদূত আমার
যা নিভেই গেছে তাকে শোনাবো কী করে
প্রিয়
বরং বুলেট শোনো,
জগন্নাথ, বলে
দাও, আর নেই গ্রাম দিয়ে
শহর ঘেরাও করা,
কৃষ্ণনগরের চারুবাক
স্টেশনের নাম মনে পড়ে তবু ট্রেন নেই
হে বসন্ত,
উত্তরের দিকে সব ট্রেন বাতিল
জলপথে যাওয়া যেতে পারে
দক্ষিণ বাতাসে আর অত কী রয়েছে জোর
পালতোলা জেলেনৌকো
ঘাট ছুঁয়ে ফিরে যাবে মা-র কাছে,
কোনও একদিন।
বন্দুক নিজেকে আর বিশ্বাস করে না তাই
যে কোনও সময় আমি বুমেরাং হয়ে যেতে পারি…
এখন বাগান করব ঘরে ফিরে সিরিয়ায় যত
খুশি গণহত্যা হোক"
বিশ্বসংসারকে উপলব্ধি করার মধ্যে,
সমস্ত দুঃখের স্রোতে নিজেকে একাত্ম করে ফেলার
মধ্যেও পোস্টমডার্নিজমের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক। দুঃখের বিলাস করতে করতে যখন একজন
মানুষ,
দুঃখের মধ্যে নিজেকে মানিয়ে নিতে নিতে যেন সেই ধূসর পৃথিবীর মাটিতে দাঁড়িয়ে উড়িয়ে
দিতে পারে যাপনের পরিসর। এতে একটি বাচন তৈরি করে দেয় প্রতিবাচনের লিপি। উঠে আসে শ্রেণি বাস্তবতা, দ্বন্দ্ব এবং
দ্বিধাবোধ। ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে
পরিস্ফুট হয় দেশের দশের সামাজিক, রাজনৈতিক
অবস্থান। আমাদের প্রতিটি অভিজ্ঞতা, প্রতিটি
চিন্তা অন্তর্ঘাতপূর্ণ করে এক সংঘর্ষপ্রবণ যাপন তৈরি করে ফেলে। ফলে গড়ে ওঠে
বহুস্বরসঙ্গতি। আমরা দেখছি এক, ঘটছে
এক। দেখা যায় তখন, আলো ভেবে যার
পেছনেছুটছি তা আসলে আলেয়া। শুধু বিভ্রান্ত করে,
বিভ্রম এনে দেয়।
আর এই গভীর দৃষ্টিপাত এবং পরস্পরবিরোধী কন্ঠস্বর হিন্দোল ভট্টাচার্য এর
কবিতাকে করে তোলে সংঘাত এবং রাজনৈতিকপূর্ণ।
যেমন এই কবিতাটি---
" চক্র "
" বাজার শাসন করে সমস্ত কাঙাল বাঘ বনে
চলে যায়
মাটিতে থাবার ছাপ পড়ে থাকে একা
হয়ত বা গাছের গায়ে একটি দুটি রোঁয়া দেখে মনে হয়
বড় খিদে ছিল তার চোখে।
মধু-শিকারীর দল কান পেতে শোনে
কোথাও হরিণ ডাকছে কিনা!
যে বন গরম,
তার কাছে থাকতে নেই,
বলে মাঝি।
ভাবে সব মৃত্যু আছে বনের ভিতরে কোনও
ঝোপের ভিতর।
বাঘের কাঙাল চোখে ধরা পড়ে সব।
নিজের মৃত্যুর সঙ্গে সে একাই চুপিচুপি
জীবন পোহায়।
বাজার বোঝে না;
লণ্ঠন জ্বালিয়ে তারা সংসার বসায় পুজো
দিয়ে।
হরিণ নীরব থাকে,
জঙ্গল গভীর হয় আরও।"
স্বর্গ আছে?
নরক? পাপ
আছে? পুণ্য?
রাত্রিডাক! চারপাশে ছড়িয়ে থাকা নিজের খণ্ড খণ্ড
অস্তিত্ব? কবি
খুঁজতে বেরিয়েছেন? হতাশ
হচ্ছেন কিন্তু আশাও ছাড়েন নি। দূরে তাই ব্যঞ্জনাময় কোকিলের ডাক। দূরে তাই ভোরের
ইঙ্গিত। এই সমাজ ভেঙে, সংসার
ছেড়ে নিজের খননকার্য। আর তারপরেই তো কবিতা উঠে আসে। আলোকিত হয় আত্মা। কবিতারূপী
আত্মাটিকে তখনই কবি খুঁজে পান। রতি নেই, অনুভব
নেই, প্রেমও নেই।
নিস্পৃহভাবে খোঁজ, নিস্পৃহতার
চরমে অবস্থান করার পরেই কবি আঁকতে সক্ষম হন তার ক্ষত চিহ্ন গুলিকে। জ্বলজ্বল করে
ওঠে। সাদা তুলোট কাগজ বহন করে ক্ষতের চিহ্নগুলি রক্তাক্ত অক্ষর। এখানে তুলোট
কাগজের ব্যবহারটাও লক্ষনীয়। স্থায়ী। এমন এক কাগজে রক্তের দাগ অর্থাৎ ক্ষতের
অক্ষরগুলি চিরস্থায়ী।
" নকশালবাড়ি "
"বিপ্লব,
আশ্চর্য শব্দ,
দেওয়াল খসিয়ে ঝরে পড়ে
আমি তাকে বলি তুমি বুনোঝোপ দেখেছ কখনও?
সে আরও খরগোস হয়-
একা একা নিজেকে লুকোয়,
যেন ধরা পড়ে গেছে।
ও কীসের দাগ?
দেখি গাছে গাছে লকলকে আঁচড়।
এ ভরা বসন্তকালে,
আগুন আদর করে কাকে?
মুখ তোলে ভগবান,-
বলে,
সব মিথ্যে কথা্,
বিশ্বাস কোর না।
মুক্তির দশক ছিল কোনও এক বসন্তের দেশে
এখন দেওয়ালে কোনও পুরনো ঠিকানা নেই,-
রঙ চটে গেছে।
পুরনো সমস্ত বই রূপকথা হয়ে যায়
লালকমল-নীলকমল দেশে।
আদর থাকে না,
তার কেবল আঁচড় পড়ে থাকে।"
একদিকে জীবন এবং মৃত্যুচেতনায় যখন
পৃথিবী হয়ে উঠছে চরম অস্তিত্ববাদী এবং অন্যদিকে মানব ইতিহাসের এক চরম সত্য
উচ্চারিত হচ্ছে তখন বাংলা কবিতায় উচ্চারিত হচ্ছে সেই সুর। কবি হিন্দোল ভট্টাচার্যও
যেন তার লেখায় সেই বিশ্বচেতনার দুঃখ, প্রেম,
আস্তিক, নাস্তিক
রূপটিকে ধরার জন্য আকুল। এই প্রসঙ্গে
আমাদের মনে পড়বে অবশ্যই টি এস এলিয়টের কথা। যিনি বলেছিলেন- Unreal
City,/ Under the brown fog of a winter dawn,/ A crowd flowed over London
Bridge, so many/ I had not thought death had undone so many,/ Sighs, short and
infrequent, were exhaled, / And each man fixed his eyes before his feet,/
Flowed up the hill and down King William Street…” যে
যন্ত্রণার জায়গা থেকে এলিয়টের কলমে এই ওয়েস্টল্যান্ড উঠে আসে,
যে যন্ত্রণার জায়গা থেকে এলিয়টের লেখায় উঠে আসে ‘
We are the hollow men/ we are the stuffed men/ leaning together/ headpiece
filled with straws, alas!, সেই যন্ত্রণাই জীবনের
বোধ। মানবতা,
প্রেম,
ভ্রাতৃত্ব অন্যদিকে অস্তিত্বসংকটের বোধ। কিন্তু ভৌগোলিক ভাবে,
আলাদা আলাদা ভাবে
প্রত্যেকে এই অনুভূতিমালার শরিক হোন। তাই আমরা দেখতে পাই "অনিবার্য
কারণবশত" কাব্যগ্রন্থটিতে সেই চিত্রকল্পের দৃশ্যগত রূপ। 'এই
তো বসন্তকাল, শহরের,
সমস্ত পলাশ/হয়ত ভীষণ রক্ত,
হয়ত আবীর/হয়ত বা অল্প দামে ঝরে পড়ে যাবে'
আবার ' কিছুই
বদলাবে না যদি তুমি না বসন্তকাল ভাব/শীতের কুয়াশা মেখে,
মধ্যরাতে, একাকী
শহরে।' কিংবা
'বসন্ত সহসা আসে,
দুয়ারে লোকাল ট্রেন যেন/আচমকা সবুজ হয় পতাকা
তোমার/নীরব গার্ডের হাতে সমস্ত সিগন্যাল যায় উত্তরের দিকে/রক্তের ভিতরে কোন যাযাবর
মনখারাপ করে /খাঁচায় বাঘিনীলোভী একা
একা পায়চারির মত?"যেমন
'বসন্ত কী হৃদয়ের
কাছাকাছি গ্রামের স্টেশন?’ লেভেলক্রসিংহীন,
মাঝেমাঝে পরিযায়ী হাওয়া/যেখানে জিরোতে আসে,
ঘর বাঁধে বাগানের বেড়া।'
'একটি গভীর দুঃখ রয়েছে কোথাও ঘাপটি মেরে/সমস্ত সুখের
মধ্যে/হাহাহিহি ন্যাড়াপোড়া জাগ্রত বসন্তে'
।
সমস্যা হল, হিন্দোল ভট্টাচার্যের
‘অনিবার্য কারণবশত’ নিয়ে কোনও কিছু লিখতে গেলেই যে বিষয়টি আসে, তা হল বইটিকে কোনও
একটা ছাঁচের মধ্যে ব্যাখ্যা করার প্রবণতা। কিন্তু এই ব্যাখ্যা করার প্রবণতার
সমস্যা হল, তা কবির কবিতাকে তার নিজস্ব যে রূপ তার থেকে ঠেলে বের করে দেয়। তাই এই বইয়ের
সমালোচনা করা খুব কঠিন কাজ। এই কবিতা রাজনৈতিক না প্রেমের না বসন্তের না সমসাময়িক
চেতনাপ্রবাহের না কি আবহমান চেতনাপ্রবাহের না নিশ্চেতনার, সে ভাবে দাগিয়ে দেওয়া
যায় না। একদিকে যেমন উঠে আসছে সমকালীন প্রসঙ্গ, তেমন তা হয়ে যাচ্ছে চিরকালীন এক
ক্যানভাস, আবার তার সঙ্গে সঙ্গেই অনেকটা সিনেমাটিক ভাষার মতো এক ভিন্ন ধরনের
মানচিত্র তৈরি হচ্ছে। আবার তার পরমুহূর্তে তা ভেঙেও যাচ্ছে। ফলে, কোনওভাবেই বাগে
আনা যাচ্ছে না। কিন্তু একটা বিষয় গভীর ভাবে বোঝা যাচ্ছে, এই বই এক আউটসাইডারের
লেখা জীবন এবং মৃত্যুবোধের যেমন, তেমন-ই গভীর এক রাজনৈতিক দর্শনেরও। কিন্তু এই
বইয়ের সমস্তকিছুই পরস্পরবিরোধী। তিনি যেমন একটি জায়গায় এসে পৌঁছচ্ছেন, পরমুহূর্তেই
সেই জায়গাকে আক্রমণ করে সেই জায়গা থেকে সরে যাচ্ছেন। দ্বন্দ্বগুলি প্রতিমুহূর্তে
নিজেকেই আক্রমণ করছে এমনভাবে, যে মনে হচ্ছে তিনি আসলে কোনও কেন্দ্রের মধ্যেই থাকতে
চাইছেন না। কিন্তু কীভাবে একজন কবি এতগুলি বিন্দুতে থাকতে পারেন? তাঁর এই দর্শন
কবিতার মধ্যে এক ভয়ানক অসহায়তার জন্ম দিচ্ছে। পাঠক কোথাও স্থির ভাবে বসতে পারছেন
না। আশ্রয় নেই কোথাও। বিষাদের মধ্যেও যেন অন্ধকার তার গলা টিপে ধরছে।
আর তাই বোধহয় ---
"আমিও তোমাকে চাই,
পৃথিবীর প্রথম পুরুষ
যেভাবে চেয়েছে তার আদিম নারীকে
আমিও ফোটাতে চাই সাদা ফুল,
লাল জবাগাছে
দক্ষিণবারান্দা যেন হয়ে থাকে আমার
দুচোখ
একপশলা দুঃখ হয়ে চাই আমি মনখারাপ হতে
রাতের বিষাদ বাজে দূরে কোনও ঘড়ি থেকে
একা
তখনই তো হাওয়া দেয়,
হে দক্ষিণ,
বেহাগ আমার
আমারও নির্জন ছিল প্রিয় রঙ,
লাল
ভাবিনি গরীব হয়ে যাবে সব দেওয়ালের লেখা
পৃথিবীতে আর কোনও বাগানের নীরবতা নেই
বুলডোজার চলে গেছে পাহাড়ের মাংস নিতে
নিতে
যখন ভেঙেছে বাঁধ,
পালিয়েছি গ্রাম ছেড়ে,
সহবাস ছেড়ে
তবু দেখো শিমুলে পলাশে আমি বহুযুগ ছুটে
আসা হাওয়া
হয়ত বলার কিছু নেই শুধু দেখে যেতে পারি
আমিও সমাধি শোনও শ্রীরামকৃষ্ণ আমি
জগন্নাথ
দেখো প্রেম হেঁটে যাচ্ছে মায়াপুর থেকে
কোন সমুদ্রের দিকে
আমিও তোমাকে চাই অনিবার্য কারণবশত
না-হলে ছিনিয়ে নিয়ে যাব" (
অনিবার্য কারণবশত )
কাব্যগ্রন্থ - অনিবার্য কারণবশত
কবি - হিন্দোল ভট্টাচার্য
প্রকাশক - ধানসিড়ি
প্রচ্ছদ - সেজুতি বন্দ্যোপাধ্যায়
Post a Comment