আমাদের নিজেদেরই মাঝে মধ্যে জানতে ইচ্ছে করেআমরা কেমন
আছি, ‘আসলে’ আমরা কেমন আছি… যে শহরের বুকে একটা বেঁচে থাকাকে পা দিয়ে মাড়িয়ে চলেযাচ্ছি রোজ, সে শহরই বা কেমন আছে? কী ভাবছে সে? আমাদের কি কোনো
পরিনতি আছে? কোনো পরিনতির দিকে কি আদৌ
চলেছি আমরা… এসব চিন্তা উঠে আসে শব্দে, বাক্যে, কবিতায় – কবি বলে ওঠেন ‘এসো, ছুঁয়ে থাকি’ ।
হিন্দোলের কবিতারা নিঃশ্বাস নেয় কলকাতা শহরেই যার
‘ঘড়িগুলো আর একসাথে বাজে না’, যেখানে ‘ভিড়ের ভিতর দিকে সকালের নির্জনতা
থাকে’, যে শহরে কোথাও ‘গলিনেই, লাইব্রেরীবন্ধ’, কোথাও আবার ‘গলির মধ্যে একটা না জল পড়ার শব্দ হয়’,
লক্ষ করলে দেখা যায় উদ্ধৃতিগুলোয় ‘অনুপস্থিতি’ কে ধরতে চাইছেন কবি। এই শহরের নির্জনতা, যে শহরে ‘একটি প্যান্ডেল থেকে আরেকটি প্যান্ডেল শুরু হয়’, সেখানে তাঁর মনে হয়‘কলকাতা শহর থেকে আদৌ কি পালিয়ে
যেতে পারো ?’ অথবা ‘পালিয়ে যাব সমস্ত অসুখ থেকে, সাবওয়ে থেকে, ফুটব্রিজ আর ঈশ্বর থেকে’- কারণ, এ শহর গ্রাস করে নিচ্ছে একটু
একটু করে প্রতিদিন আমাদের সত্ত্বা, শুষে নিচ্ছে জীবনের নির্যাস।
‘ এদেশে বিশ্বাস করো খিদে বেশি, তাই পাতা ঝরে ’ – এমনই ভাবে প্রকৃতির প্রতিক্রিয়া মিশে যাচ্ছে আমাদের অবস্থার সাথে, আর ‘মানুষ নিজেকে তার খিদের হিসেব করে নেয়; কম দুঃখ পেতে শেখে ’- এক আমোঘ সঙ্কট জড়িয়ে ধরেছে আমাদের। বর্তমান অবস্থা আসলে এক নীরব ট্র্যাজেডি যা আমরা বয়ে
চলেছি প্রতিদিন, দশকের পর দশক ধরে - ‘কেউ কেউ মৃত আর কেউ কেউ হয়ে যায় আবানুগমনকারী’, কবিতা কে নিয়ে থাকেন চুপচাপ
এক বিশাল শবযাত্রার দিকে, হয়তো
ফোন করেন ভাস্করচক্রবর্তী- কে।
ট্র্যাজেডির অংশ সবাই, কেউ ছাড় পায়না, - ‘ঘড়ির ভিতরে বসে ঈশ্বর উদাস থমথমে, কী ভীষণ একাভাব! মৃত্যুও বন্ধু নয় তার!’ – ঈশ্বরও যেন আমাদের মতোই রক্তমাংসের, মানুষের মতোই অসহায়, বিমর্ষ, একা - নির্বান্ধব, এমনকি আমাদের চেয়েও – যার কাছে মৃত্যুও ঘেঁষে না।
ট্র্যাজেডির অংশ সবাই, কেউ ছাড় পায়না, - ‘ঘড়ির ভিতরে বসে ঈশ্বর উদাস থমথমে, কী ভীষণ একাভাব! মৃত্যুও বন্ধু নয় তার!’ – ঈশ্বরও যেন আমাদের মতোই রক্তমাংসের, মানুষের মতোই অসহায়, বিমর্ষ, একা - নির্বান্ধব, এমনকি আমাদের চেয়েও – যার কাছে মৃত্যুও ঘেঁষে না।
কবি জানেন ‘সব মফসসল আজ কলকাতার দিকে কাটে ভোরের টিকিট’, উপার্জনের জন্য
সবাইকেই আসতে হয় শহরে । এই বন-জঙ্গল-মফসসলের সঙ্গে শহরের আলাপ বহুদিনের, যেখানে ঘুরতে যাওয়ার আগে শহরবাসীরা এখনও সাবধানতা অবলম্বন করে ‘ওডোমস মেখে নিয়ে দেহে’, শহরে জঙ্গলের উত্তেজনা আর জঙ্গলে গিয়ে শহরের উন্মাদনা ভরে দিতে
চায়, নিয়ন্ত্রণ করতে চায় প্রকৃতির স্বাভাবিকতাকে।
কিন্তু এইসব শহরবাসীদেরই বুকের ভিতরে - ‘এক একটি শ্মশান জ্বলে থাকে সারাজীবন ’, শুয়ে পড়ে ‘শহরের অনন্ত হেমন্তকাল’। লক্ষ
করি ‘শ্মশান’
আর ‘অনন্ত হেমন্তকাল’ দুটোই একটা চূড়ান্ত দৃশ্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছে,
তবে এই মানুষ কি অভিশপ্ত? ভীত? অবশেষে পরাজিত? তাইকি
‘হয়তো যুদ্ধের জমি এখনও প্রস্তুত
তবে আমরা সেই যুদ্ধ ভুলে গেছি;
তেমন শাণিত
অস্ত্র নেই,
বর্ম ভাঙ্গাচোরা
আর -
শিরস্ত্রাণ স্বাভাবিক নয়।’
এখানে অস্ত্র, বর্ম আর শিরস্ত্রানের ভগ্নরুপ কি বোঝাতে চাইছে আমাদের
মানসিক ও শারীরিক অবস্থা? হয়তো তাই...কবির অনুকম্পা জাগে আমাদের ক্ষয়ে যাওয়া আত্মসম্মানের
জন্য ।
ভয় পেয়েই কি আমরা আজ যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে চাই না? এই ভয়ই উঠে আসে আবার অন্যপ্রসঙ্গে-‘হেরে যেতেযেতে ভাবে / জিতে গেছে হয়তোবা / তবু হেরে যায় /’ – এখানে ভয় শেষপর্যন্ত হেরে যাচ্ছে, কবি কিন্তু আশাবাদী – একটা দোটানা চলে তার মনের
মধ্যে, এই দোটানা মেজাজ আগে প্রকৃত সত্যকে
গ্রহন করার ইচ্ছে থেকে, ভয়ও সন্ত্রাসের সময় সত্যি-মিথ্যে সব একাকার হয়ে যেতে পারে তখন ‘মনের মধ্যে তাড়া করে দূর থেকে / মশাল, বন্দুক, ছুরী, খোলা তরোয়াল’ – বর্তমান যুগে সন্ত্রাসের ভূমিকা এড়ানো কঠিন, অবচেতনে এর ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
অসহায় মানুষের ‘মাথার ভিতরে মিশে যায় ঘড়ি, ফাঁকাঘর, গোটানো পোশাক; কীভাবে দেবতা কেউ এসে সব বদলে দেবে
ভাবি।’ – এখানেও সেই মহাশক্তির উপর নির্ভরশীল আমরা, যিনি
হয়তো নিজেই অপারগ । আরও এক জায়গায়‘ তবু অপেক্ষা করছি,
যতক্ষণ
না সমুদ্র ফিরিয়ে দেয় দেহ/
খোলাব্যাগ, মুক্তোর ধূসর ঢাকনা, শামুকের খোল আর ঈশ্বরচেতনা’- কবি পরিত্রাণ চাইছেন মানুষের হয়ে, এই আকুতি – তাণ্ডব থেকে উদ্ধার পাওয়ার এক শেষ প্রার্থনা – এ যেন আমাদেরই, তাই 'একটি ক্ষুর্ধাত বাঘ লাফ দেয়
চুপিচুপি অসহায়ভাবে '।
কবিতাগুলোর মধ্যে বারবার ফিরেআসছে হেমন্তকাল, এই হেমন্ত কি মুক্তির প্রতীক? বিপর্যয় ও মারাত্মক অবক্ষয়ের সময়ে কবি কি হেমন্ত-কেই কি শুশ্রূষার ওষুধ বলে চিহ্নিত করেছেন? এখানে হেমন্ত ‘টোকা দেয়’,
‘ঝরে পড়ে’, ‘ শুয়ে পড়ে’, ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়েছে –
হেমন্তকালের
প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছেন কবি, তা কি নিছকই কাব্যিক ব্যাঞ্জনা? না, ‘হেমন্ত’ এখানে, কবির শহরে প্রট্যাগোনিস্ট,
যাকে 'ছুঁয়ে থাকেন' কবি, যেমন 'ছুঁয়ে থাকেন' মৃত্যু ও প্রেম-কে,
জীবনানন্দের
কথা মনে পড়ে যায় পাঠকের। যেখানে প্রেম একটা ‘বিয়োগচিহ্নের মতো ভারী’ ক্লান্ত সুতোর মতো পড়ে থাকে, সে অবস্থাতে কিন্তু কবি বিশ্বাস হারাননা –
গেয়ে ওঠেন ‘যত দূরে যাও তুমি; মিলন হবেই, তাই এতকাল বিরহে থেকনা’। হিন্দোল উপলব্ধি করেন সমাপ্তির প্রবণতা, ইঙ্গিত করেন নিয়তির দিকেও - ‘যেদিকে যাওয়ার জল সেদিকেই যায় ’কিংবা ‘কেউ জাগে, কেউ বা জাগায়’ শেষের যত কাছে চলে আসি আমরা, আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে ‘আমরা কোন দিকে যাব? ওদিকে তোমর্গের বাতাস’, কবি উত্তর দেন - ' আমাদের পেরিয়ে যেতে হবে নিজেদের
' – এখানেই
বিশ্বাস, প্রতিজ্ঞা, হেরে না যাওয়ার অঙ্গীকার, মুক্তির ক্ষীণ
আভাস –যখন আমরা জেনে এও গেছি যে, আমাদের প্রত্যেকের আয়ু নির্ধারণ করা আছে।
হিন্দোলের কবিতারা অন্ধকার চিরে দেয় না, বরং অন্ধকারকে
নীচে ফেলে উপরে উঠতে চেষ্টা করে, আমাদের ঠেলে দেয় অন্য এক গুঢ় গন্তব্যের দিকে; কানে-কানে
বলে - ' রাস্তাই রাস্তার জন্ম দেয়/ যত দূরে থাক, তাই/ আমাদের যাওয়া শেষ হয় না কখনও'
। মনে করিয়ে দেয় যে আমারা এ জগতসংসারে ' পর্যটক' মাত্র, পৃথিবীর 'সরাইখানা'য় চিরকাল
বসবাস করতে আসিনি - ' দূর থেকে সব লক্ষ করো, দৃশ্য আসে যেমনভাবে চোখে/ তোমার দেখার
কথা কেবল, শস্য গোনা নয়' , মনে পড়ে যায় কোনো প্রাচীন মন্ত্র, শাশ্বত দর্শনের কথা
- যেখানে জীবনের সব সুখদুঃখ ক্ষদ্র হয়ে আসে...
Post a Comment