সৌমনা দাশগুপ্ত
খুলতে খুলতে পাখি
কিছু কথা বলে যাব আমি, কিছু কথা ছায়ার মুখেতে
শূন্য লেখা শাদা পাতা জুড়ে, মৃত্যু লেখা নটেগাছটির
শিরে যদি বজ্র নেমে আসে, বিল্বপত্র অযুত নিযুতে
ভেসে ভেসে ভেসেই যেত… ভাগ্যে ছিল পাতার কুটির
তা না হলে গল্প কোথা যেত, রাত্রিজাগা ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী
কাঁথাকানি দিয়ে স্বপ্ন চাপা দিতে দিতে ছিটকে পড়ছ কক্ষ থেকে, গুঁড়ো গুঁড়ো ঝরে গেছে তারা। বামনের এই দেশে কতো কতো ভয়। ট্র্যাকে থাকার ভয়, টলমল করে শুধু হাইহিল জুতো। ভয় গেঁথে মিনার বানিয়ে এই ঘর। চির ধরে দেয়ালে মেঝেতে। গরগর করে ওঠে চারাগাছ। কাম ও ফসলে ভরা এ পৃথিবী রতিচিহ্নময়। সে গাছে ধরেছে ফুল, পরাগদণ্ডটি নাচে ইশারায়। আগুন শরীরে নিয়ে ছুটে যায় ধূমকেতু, সে অগ্নিতে দিতে হবে খনিজ লবণ; ভালনারেবল যতো হাড়, বাজায় তাদের বীণা, ওই শোনো দরবারি রাগিনীতে জেগে উঠছে ধাতুচূর্ণ; প্রথম আকর
কাটামুণ্ড ভেসে যায় কাটা হাত ভাসে
এরা সব কোথা ছিল কোত্থেকে আসে
ছায়াটি কেবল দেখে নির্নিমেষ চোখে
ধায় দৃষ্টি যায় দৃষ্টি নভ অভিমুখে
কিছু গল্প লেখা ছিল বজ্রের গায়ে
বৃষ্টি হয়ে ভেসে গেল উত্তরের বায়ে
ভেসেই যদি যেত সব গল্পগাছাগুলি
কথক তবে কেমনভাবে খুলত তার ঝুলি
তারপর সেই মহাসর্প জড়াবে আমাকে পাকে পাকে। অনন্ত চলার পথে পথে রাখা আছে কথা এবং ছবি। কিছুটা তার কুড়িয়ে নিয়ে চলি, কিছু থাকে ভুলের ইঙ্গিতে। একটি আয়না, তার মধ্যে দিয়ে উঠে গেছে সিঁড়ি।
আয়না তখন খুলে ধরছে দরজা। মার্কারির প্রলেপ খসিয়ে সে তখন স্বচ্ছ এক কাচ। কাচের ভেতর দিয়ে উঠে গেছে সিঁড়ি। আর ক্লোজশটে দ্যাখা যাচ্ছে, এক তুমুল ঘূর্ণন। পরের দৃশ্যে আমরা দেখতে পাচ্ছি, আয়নার সমস্ত শরীর জুড়ে একটি গভীর রাস্তা। সেই পথে হেঁটে যাচ্ছে ছায়া। কোথায় যাচ্ছে সে? সে কি পুনরুদ্ধার করবে আদিম প্লাবনের পূর্ববর্তী গাথা ও সঙ্গীত! কীভাবে সূর্যের প্রথম রশ্মি বিচ্ছুরিত হয়েছিল শিলাপট্টে, কীভাবে আদিম পয়োধির থেকে জেগেছিল এককোষী প্রাণ!
এক পা এক পা করে এগিয়ে চলেছে
ছায়া ধুনিটির দিকে; ধুনির ভিতর দেখে
কাঠ নয় হাড়গোড় করোটি ও মজ্জা পোড়ে
মাংস পোড়ার গন্ধ নাকে এসে লাগে
ছিটকে উঠছে ঘিলু ছিটকে উঠছে লাভা
তবু সে ধুনির মাঝে খুঁজে পায় জীবন্ত মানুষ
তার মুখে লেখা আছে সময়ের দাগ
নিনেভা নগর এক; তার সব দগদগে ক্ষত
হৃৎপিণ্ডের প্রতিটি চেম্বার থেকে প্রতিফলিত হচ্ছে দলা দলা অন্ধকার। একটি বিষণ্ণ ঘর, সিলিং থেকে আংটা দিয়ে কে যেন সাজিয়ে রেখেছে সারি সারি দেহ, চামড়া ছাড়ানো। ওপাশে প্রস্তুত হচ্ছে গনগনে একটি তন্দুর। তুমি কিন্তু আস্তে আস্তে সইয়ে নিচ্ছ এই তাপ, আর একটি স্বপ্নের থেকে আরেকটি স্বপ্নের দিকে যেতে যেতে ক্রমেই স্বচ্ছ হয়ে উঠছে শরীর। ফিসফিস করে ওঠে কাচের মানুষ
মনে করো আমরা দুজন
চিতাতুতো ভাই-বোন
আদি-সহোদর
পাশাপাশি জ্বলেছিল দুটি দেহ
অবাক ছায়াটি বলে, ভুল কথা
বপণের আগে আর পরে
দুটি বীজ উড়ে গিয়েছিল
যদি বা দুখানি চুল্লি জ্বলে
পাশাপাশি, তবুও পৃথক তারা
দেখছ না আগুনের কত কত শেড
মাননীয় দর্শক ও শ্রোতা বন্ধুরা, ছায়ার এ হাসি কি আয়না ভেদ করে, স্বপ্ন ভেদ করে আপনাদের কর্ণকুহর অব্দি যাচ্ছে? লাইট, সাউন্ড, স্টার্ট...
স্বপ্ন দাও, স্বপ্ন দাও, সুলক্ষণযুক্ত স্বপ্ন চাই। অতীব ফর্সা, সুন্দরী, গৃহকর্মনিপুণা, সুউপায়ী স্বপ্ন চাই! আর কাদার তালের ভেতর গড়িয়ে যেতে থাকে একটি লাল বল। ধারাভাষ্যের টেস্ট-ক্রিকেট
লালঘুড়ি যদি হয় স্বপ্নের প্রকাশ
নীলঘুড়ি তবে জেনো দুঃখপাতা ঘাস
কাটাঘুড়ি পড়ে থাকে রেলের লাইনে
মুণ্ডহীন সূত্রহীন জোনাকিরা জানে
ইচ্ছেগাছে বিষ ঢালে গোখুরার জিভ
ফুটন্ত সিসার তাপে গলছে অলিভ
জলপাই বনের মাঝে পতঙ্গটি থাকে
কীরূপে বর্ণিব সেই অভিনেতাটিকে
যে হাড় ফুটিয়াছিল বাঘের গলায়
সে হাড় প্রথম অস্ত্র শিকার খেলায়
একটি কোদাল আর একটি গামছা মাটি খুঁড়ছে, মাটি খুঁড়ছে। অনন্ত কবরের নিচে শুয়ে থাকে একটি পিয়ানো। শুধু ব্যাকগ্রাউন্ডে শোনা যায় তার ডাক। নীল রঙের ব্যাকড্রপে ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে বাঘছাল। নীলরঙের ব্যাকড্রপে ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে খিদে। খিদে এক অসমাপ্ত চিৎকার
মন্ত্রগুপ্তি ভেঙে আসে এক বেয়নেট, অর্ধমাত্রায় ভাঙে
প্রতিটি স্তবক আর হাসির বলক থেকে উঠে আসে
চলচ্ছবি, বিনির্মাণ, জীবনের টুকরো টুকরো পাতা
ঘামের প্রলাপ লেগে তার গায়ে ফুটে ওঠে
বিষদাঁত, হলাহল। যেন সে ফুটন্ত চুল্লি এক
স্পর্শমাত্র ফেটে যাবে; কঙ্কাল ঝাঁকিয়ে দেখি
রক্তস্রোত বেজে যাচ্ছে হাড়ের বাঁশিতে
প্রথম স্তবকে শুধু খিদে লেখা ছিল
ছায়াগুলি এখন থেকে আর কোনও নির্দেশ মানছে না। ধ্বনি ও প্রতিধ্বনির নকশা ছিঁড়ে তারা এখন বুনো ও হিংস্র এক একটি শার্দূল। এগিয়ে আসছে থাবা। ঘাড়ের ওপর ফুটে উঠছে নখের আঁচড়, রক্তাক্ত। আর তুমি ঢেকে দিচ্ছ ঘড়ির কাঁটা, আর তুমি ঢেকে দিচ্ছ ক্যালেন্ডারের পাতা। তৃতীয় স্বপ্নের ভেতর ঢুকে যেতে যেতে শুনতে পাচ্ছ একটি গম্ভীর ঘণ্টার ডাক, ক্যাথিড্রালে ক্যাথিড্রালে তখন সুসজ্জিত হচ্ছে ক্রুশকাঠ, এবং তুমি খুলে ফেলছ যাবতীয় পোশাক, এবং তুমি খুলে ফেলছ যাবতীয় আসবাব। তুমুল ভূকম্পনের মধ্যে ঘরের দেয়াল ফাটিয়ে উঠে আসছে এক মহারণ্য, সিমেন্টের আস্তর ফাটিয়ে নেমে যাচ্ছে সিঁড়ি
নিজেকে লুকিয়ে রাখি, আমি জানি অর্থহীন
এই ছবি, এই ধোঁয়া, আগুনে পোড়ে না তার শব
প্রতিটি দৃশ্যের গায়ে লেগে আছে কিছু গান
কিছু বা গন্ধের স্মৃতি, এভাবে রিলেট করি
মাটির খুরিতে ঢেলে পান করি সে তরল
আখ্যান বলে না তাকে; মাজাভাঙা সেতুটির
স্বপ্নগুলি পড়ে আছে কবরখানার মাঠে
বেভুল শকুন সব, ঠুকরে ঠুকরে ফেরে
অট্টহাসিতে দুলতে থাকে সিঁড়ির সবকটি ধাপ। আসলে কোনো বন্দুকই ছিল না। বারুদের গল্পও ছিল মিথ্যে মিথ্যে। আমাদের ধুতুরার দিনে, আমাদের বাস্তুসাপের দিনে মারী ও হত্যার দাগ আকাশকুসুম হয়ে ফুটে ছিল। ঘর বলো ঘর, বাগান বলো বাগান, হাওয়াবাতাসের কিছু ফিসফিস, একটা দুটো মরুভূমির কথা তো জমা থাকত তোমার হাতবাক্সে। শুধু শুধুই মুখে ফেনা তুলে তুমি বুলি শেখাচ্ছ অনুকরণ-প্রিয় সেই কাকাতুয়া পাখিটিকে। আর জাদুতাস নিয়ে খেলা দেখাতে দেখাতে সূর্যাস্তের দিকে চলে গেল তোমার গলার স্বর। তুমি কি এবার আবহাওয়া বিষয়ে কিছু বিবৃতি দেবে, তুমি কি এবার একটা চুমু খেয়ে নেবে হাওয়ামোরগের ঠোঁটে! এসব ছেনালি ভালো। আরও ভালো এই কল্কে, যা তোমার মজ্জার ভেতর ঢুকে বসে টান দিচ্ছে তোমারই দমকুঠুরির একমাত্র জানলায়
পরাগহীন দণ্ডগুলি, তাক করছে
কাম ও কামান যতো, খ্যা খ্যা হেসে
দ্বিধা ও বিদ্রূপ ছুড়ে দিচ্ছে শূন্য পাত্রে
পুরীষবৃষ্টিতে ভাসে, ভিজে যায় ফিরোজা গোধূলি
তবু সে লিখবে পাখি লিখে যাবে উড়াল-আখ্যান
কুণ্ডলিত শুয়ে আছে মহাসর্প; তাকে দাও উত্থান
পাথর লোহা ও তাম্র যুগের শেষে আণবিক যুগ
বৃতি থেকে ফুটে ওঠে বারুদ-পুষ্প, মৃত্যু-আঙ্গিক
যদি ফুল আসে গাছে, যদি একদিন ঝংকারে
শব্দ মুকুলিত হয়; ডাকে ডাকে ভরে যায় পাড়া
ভরে দিতে হবে সব চরিত্রের মাথায় মাথায় অ্যান্টিডোট, এ ভাইরাসের। তবে তো জীবন্ত হবে পার্ট বলা, সমুদ্র মন্থন শেষে উঠবে অমৃত। উড়বে গল্পের গাছ, হা হা এক রানওয়ে ছাড়িয়ে আকাশে পৌঁছে যাবে; ঘরে নয়, বাইরেও নয়, কালপুরুষের জল খসে পড়ে মাথার ভেতরে।
অযুত সূর্যাস্ত শেষে শাদা এক কবুতর ডানা মেলে দিয়ে তার উড়ে যাচ্ছে শুকতারাটি লক্ষ্য করে। সমস্ত আকাশ জুড়ে প্রকাশিল দিনমণি। বারংবার লুণ্ঠিত মন্দিরের মাথায় ততক্ষণে লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে রজ-রক্তে ভেজা এক টুকরো কাপড়, উড়ছে উড়ছে...
দৈবমথ এসে বসল আয়ুরেখায়
সে কি প্রহেলিকা
শব্দের কবর খুঁড়ে তুলে আনছি গতিজাড্য
গদ্যের সীমানা জুড়ে টাঙিয়ে দিচ্ছি অন্ধকার
যদিও লেটারপ্রেসের দিনে
এক বৃদ্ধ কম্পোজিটার বলেছিলেন
তৎসম শব্দের ভারে ডুবে যাচ্ছে
অনুবাদের লোহার জাহাজ
শুধু ব্যথা চিহ্নিত হয়
হারিয়ে যাচ্ছে পাখি ও প্রবাদ
বলেছিলেন, ডানা লেখো
শতদল হরিণের স্রোতে উড়ে যাও
নক্ষত্রের রতিবাদ্য, সেইখানে তুমুল দাদ্রিম
লড়াইয়ের দু’দিন আগের থেকে অভুক্ত রেখে দাও, সাতদিন আগের থেকেই ওদের খাঁচার ভেতর ছুড়ে দাও ওদেরই নাড়িভুঁড়ি, যকৃৎ ও প্লীহা। অভ্যস্ত করো, অভ্যস্ত করো... তবেই না জমে উঠবে গ্ল্যাডিয়েটরের এই খেলা। সেদিন থেকে রক্তের গন্ধ তোমারও ভালো লাগতে শুরু করবে। হাত উপচে উঠবে চর্বি ও মজ্জায়। তখন দেখবে কী অনায়াসে সেলাই করে ফেলছ এই চিত্রনাট্য। সবটাই দর্জিগিরি। কারিগরি কুশলতা। ছায়া নাচাতে নাচাতে তুমি নিজেও তখন এক ছায়া
দণ্ডবৎ এ শ্রীময়ী ক্ষুরে, দণ্ডবৎ সমিধের স্তূপে
আগুনের ধারার মতো পড়ুক ঝরে পড়ুক ঝরে
এত যে হরিণকথা; দৌড় শুধু দৌড় লেখা পাতা
শ্রাবণ শ্রাবণ আমি তোমার দাওয়ায় যাব
নিয়েছ শ্রাবণ এই দেহজ-গুল্মের ভার
পড়ে ছিল বিল্বপত্র তার তো সামান্য আহার
স্বস্তিক চিহ্নের পাশে ও কার মুখ উঁকি মারে
তারে এসে বসে আছে শাদা-প্যাঁচা, অন্ধকারে
চাঁদ তো বাসনামাত্র; আলোর পেছনদিকে
লেগে থাকে ঝুলকালি; মাকড়সার পুঁজ ও
রক্তের দাগ
সমান্তরাল কয়েকটি রেখা ফুটে উঠবে দিকচক্রবালজুড়ে। ভ্রূকুটির ইঙ্গিতে নুয়ে পড়ছে খেজুরপাতা। বুননে এতোটা কারিকুরি, স্তবকের ঘাম লেগে যাচ্ছে, আর টলে যাচ্ছে কেন্দ্রবিন্দু, আর গ্রীষ্মদুপুরের ভাঁজে দুলে উঠল নীরবতা।
রিভলভিং স্টেজ। ঘুরে যেতে হবে তোমাকেও। একটি স্বচ্ছ কাচও একদিন আয়না হয়ে উঠবে। ওই তো সামান্য মার্কারি, তারও কতো গেরামভারী পা, আসব-আসছি করে দিন যায়, দিন যায়... মুচকি হাসছে কাচ, কী নখরা, কী নখরা! ছবি ধরে রাখবার এ-ও এক জাদুবাক্স, নার্সিসাসি উপত্যকা, স্মৃতিদষ্ট, একটি করে দৃশ্য মুছে যেতে যেতে ফুটে উঠছে আরেকটি দৃশ্য। কেউ একটা মাছির চোখে বসিয়ে দিচ্ছে আতশ কাচ। চোখ নাচছে... নাচছে...
অন্ধকার খুলতে খুলতে দেখে ফেলছ...
দেখে ফেলছ...
দেখে ফেলছ...
Post a Comment