কবিতা ভাবনা সংখ্যা -এক
কবিতার নিজস্ব ঈশ্বর
দীপান্বিতা সরকার
একা আমি৷ এই একা আমার মনোজগত, সাধনার জগত,
একাকী আমার ভাবনার গহীনতা নিয়ে আমি পৌঁছতে চাই তোমাতে, ছুঁতে চাই তোমাকে। আমার সমস্ত জীবনানুভূতিকে আবেগ, কল্পনা
আর মননের জারকে রাঙিয়ে আমি তোমার মনের অতলান্তে অবগাহন করতে চাই। জীবনের প্রতি
মুহূর্তবিন্দু, তার প্রতিটি পতনের শব্দ আমি জানতে, চিনতে চাই৷ তাকে রতনে ভূষণে সাজিয়ে যে রূপ দিয়ে তাকে তোমার মনোভুবনে হাজির
করি, তাই-ই তো আমার কবিতা৷ এই যে একান্ত আমি থেকে তোমার
অভিমুখে যাত্রা, তা একটি সামাজিক প্রক্রিয়া। কবিতা লেখা তাই 'একাকী মানুষের সামাজিক আচরণ'। আমার প্রতিটি পাঠক সেই 'তুমি'টি৷ আমার বোধ দিয়ে তোমার চেতনা, তোমার বোধকে উন্মীলিত
করতে করতে আমার কল্পনার সর্বস্ব আমি তোমাকে দেখাই, চেনাই৷ এই
চেনানোর তাগিদেই আনন্দ, দুঃখ, বিচ্ছেদ,
বিরহ বিষাদ সব যেন হয়ে ওঠে শিল্পীত সুন্দর। সেই সুন্দরের রূপ
দেওয়াতেই একজন কবিতাপ্রয়াসীর চির আনন্দ। সেই আনন্দেই আমি কবিতার কাছে আসি।
আমার প্রতিদিনের ব্যক্তিজীবন, সামাজিক জীবন নানা ঘটনার অভিঘাতে আহত, দীর্ণ, দ্বিধাজর্জরিত। অজস্র বয়ে যাওয়া মুহূর্তের অনুভূতি, আবেশ আপন মনোভূমির নিজস্ব পারিপার্শ্ব রচনা করে চলেছে। আর এই সমস্ত কিছুর মধ্যেই একটা চোরাস্রোতের মতন বয়ে চলেছে কবির মর্মশাঁসটি। অনুভূতিপ্রবণ মানুষের ইন্দ্রিয়গোচর ও ইন্দ্রিয়াতীত জ্ঞান ও উপলব্ধি অনেক গভীরে বিধৃত ও বিস্তৃত থাকে৷ তা সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক বেশি সুবেদী, সূক্ষ্ম ও সংবেদনশীল। একজন মানুষের আত্মজিজ্ঞাসা, প্রেমানুভূতি, দুঃখবোধ, বিচ্ছেদানুভূতি, আনন্দ বেদনা বিষাদের যত অন্তঃশীল যোগসূত্র, তা সবই তীব্রতর আকুল তরঙ্গাভিঘাতে নিত্য ক্রিয়াশীল একজন কবির মানসপটে। একজন কবি তাই বোধহয় সব সময় লেখেন। কাগজে কলমে, কী বোর্ডে না হলেও, মাথায়, মনে সে সব সময় লেখাকে ধারণ করে থাকে৷
আমারও অনেক সময়ই এমন মনে হয়৷ রান্না করতে করতে, ঘর গোছাতে গোছাতে, ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে, জীবিকার কেজো ঘিনঘিনে লেখা লিখতে লিখতেও আসলে আমি কবিতাই লিখি৷ আমার মন জগতের সব কিছু থেকেই কবিতার রশদ সংগ্রহ করে নিজেরই তাগিদে, নিজস্ব ভুবন রচনার তাগিদে, যে ভুবন না হলে আমার অস্তিত্ব প্রায় নেই বললেই চলে৷ আমার মন, আবেগ, বোধ, চিন্তন সমস্তটা একাত্ম করে একাগ্র করে আমি আমার জীবনের ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনাকে অনুবাদ করতে চাই কবিতায়। কবিতাই আমার সবচেয়ে সৎ সর্বাপেক্ষা গভীর আত্মঅভিব্যক্তি৷ খুব ছোটবেলায় অনেক কিছু এলোমেলোভাবে লিখে রাখতাম যাকে কবিতা বলা যায় না৷ কলেজ ম্যাগাজিনে প্রথম ছাপা লেখাটিকেও আর আজ কবিতা বলতে চাই না। যদিও সেটি অনেকের ভালো লেগেছিল৷ মনে পড়ে, লেখাটিতে কিছু উচ্চকিত সামাজিক বার্তা ছিল৷ কিন্তু কবিতা হয়ত ছিল না, আজ বুঝি৷ তখনও কিছুটা বুঝেছিলাম৷ আর সেজন্যই যতদিন না নিজে মনে করেছি কবিতা হয়েছে, ততদিন আর ছাপতে দিইনি কিছু৷ কবিতাসমাজে কীভাবে কোন নিয়তির পথ ধরে ঢুকে পড়লাম জানি না, কিন্তু লিখতে এসে যাদের সঙ্গে আলাপ হল, তাদের পেয়ে ভারি আনন্দ হল। তাঁরা কী সুন্দর কথা বলে, কী সুন্দর লেখে। আমার ভাবনার সঙ্গে কত মিল তাদের ভাবনা জগতে। কিংবা অমিল, অমিলটাও ভালো লাগে। এমন মানুষই তো এতদিন খুঁজছিলাম মনে হল৷ আমার লেখালেখির ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে বন্ধুদের ভূমিকা, অনুপ্রেরণা তাই অনস্বীকার্য। তারপর দূর থেকে কাছ থেকে কত প্রিয় কবিদের দেখলাম৷ কবিতা লিখতে এসে সঠিক ভাবে কবিতা পড়তেও শিখলাম। নিভৃত পাঠ, নিবিড় পাঠে কত যে মণিমুক্ত খুঁজে পেলাম! ধীরে ধীরে কবিতা লেখাই আমার জীবনের সমস্ত ঘটনাকে, নিয়তিকে নিয়ন্ত্রিত করতে লাগল।
আমার ব্যক্তিগত কবিতাভুবন জুড়ে রয়েছে এক নিজস্ব ঈশ্বর৷ জীবন থেকে তাঁকে আলাদা রাখতে পারি না৷ নিবিড়ভাবে সেই ঈশ্বর আসন পেতে আছেন আমার জাগতিক সমস্ত বোধে, কাজে ও যাপনে৷ সেই ঈশ্বর গভীর হৃদয়াবেগের, আধ্যাত্মের, প্রেমের। তাঁর দিকে অভিসারই আসলে আমার কবিতার দিকে যাওয়া৷ মাতৃগর্ভে থাকার সময় থেকেই সেই নিজস্ব প্রেমের ঈশ্বর আমার ললাটে, মুখভঙ্গিতে, জীবনভঙ্গিতে আলিপ্ত করেছেন কবিতাকে, এমনই আমার বিশ্বাস। আমি যখন অনেকদিন লিখি না, মানে সত্যি সত্যি কবিতা লিখি না, তখনও তিনি সঙ্গেই থাকেন আমার সকল কাজে, অকাজে, আলস্যে, আমার কবিতা হয়ে৷ আমার কবিতা আমারই তৈরি করা এক অবয়বঘোর, একটি আতপ্ত শরীর৷ তা কি আসলে আমারই আত্মা নয়? যে আত্মা প্রেমে, দুঃখে, শোকে, আদরে আঁচল বিছিয়ে নিজেকেই আশ্রয় দেয়, রক্ষা করে। কখনো কখনো নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতেও পারে না। কিন্তু লিখে চলে, কেঁপে ওঠে আকাশের নীচে৷ যে হৃদয়ে কবিতা আছে, বিশ্বাস করি সে সব শোক শুষে নিয়ে তাকে অনুবাদ করতে পারে ফুলে, রঙধনুতে, সবুজ পাতায়, মুক্ত নীল আকাশে৷
আমার প্রতিটি কবিতার বই আমার আত্মজ। আমি চলে গেলেও ওরা সন্তানের মত থাকবে৷ হয়ত সবার অলক্ষ্যেই থাকবে৷ তবু থাকবে। আমার কবিতা সেই সেই মুহূর্তে (যে মুহূর্তে জন্ম নিচ্ছে) আমারই মনের প্রতিবিম্বিত সৎ উচ্চারণ। আমার লিখিত একটি কবিতার একটি লাইনকেও তাই আমি অস্বীকার করতে পারি না। জন্মমুহূর্তে সে ছিল হৃদয়জাত। যাপিত জীবনের যে কোনও মুহূর্ত, তা ভুল হোক, ঠিক হোক, আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তেমনই তা থেকে উতসারিত কবিতার প্রতিটি শব্দও আমার কাছে ততধিক মূল্যবান ও সত্য।
ছবি -ফ্রিজ থলো
দুপুরবালক ও স্নেহগাছের ছায়া
নিত্যানন্দ দত্ত
যে ভ্রমর একমুখ পরাগের আশ্লেষ নিয়ে উড়ে যায় কলমিফুলের গায়ে
তার না থাকার চিহ্নটুকু রেখে। বাতাসের গায়ে গায়ে তার উড়ে যাওয়াটুকু দৃশ্যপথের
আড়ালে হারায়। হেমন্তের অপরাহ্নবেলায় নরম হাওয়ায় লকলক করে পূর্ণগর্ভ ধান। যা কিছু
নয়নপথগামী, মুহূর্ত তাকে দৃশ্যের আড়াল করে। কিমবা আড়াল
হয়না কেউই। নিঃশব্দে অন্তরে প্রবিষ্ট হয় । কত কত দিন পড়ে থাকে অচেতন। পুরনো
দেরাজের মতো ধুলো জমে গায়ে। এইসব গুপ্তধনের কথা ভুলেই যায় সে। তারপর একদিন তারা
তপ্ত লাভাস্রোতের মতো চেতন অবচেতন তোলপাড় করে ভাসিয়ে নিয়ে যায় তার সচেতন
অবস্থানটিকে। তখন ভূতগ্রস্ত সে শুধু সমর্পন করতে পারে নিজেকে। যেমন হলুদ পাতাটি
গাছ থেকে চ্যুত হয়ে মহাশূন্যে ঝাপ দেয় । সে জানেনা কোন মাটিতে স্থিত হওয়া তার
ভবিতব্য। কোথায় যাবে সে জানে না। কোথায় যাওয়ার কথা ছিল সে জানেনা। শুধু সে জানে এই
শূন্যে নির্ভার ভেসে থাকাটুকুই শুধু সত্য।
এই যাত্রাপথটুকু শুধু সত্য। আবহমানের এই অনন্ত স্রোত, সত্য। আচমকা বিদ্যুৎচমকের মতো মাথায় অক্ষর এসে ভিড় করে। সেই ভিড়ে আরও আরও
শব্দ এসে মেশে অবিশ্রাম। বাজারের কোলাহল, স্কুলের কর্কশ
ঘন্টাধ্বনি, মিছিলের চিৎকার সবাই মিলে সেই নতুন আসা
শব্দগুলিকে মুছে দিতে চায় প্রাণপণ। আর সে পাখিমায়ের মতো ডানার আশ্রয়ে আড়াল করে
রাখে তার সদ্য শব্দশাবকদের। কেননা সে জানে তারাই আশ্রয় তার। একদিন যেমন ছিল সেই ছোট্ট কুটিরটি।
তার খড়ের চাল। খড়ের দেওয়াল। আদিগন্ত খেতের মাঝখানে এক মহা পৃথিবী।
সদ্য ফুল এসেছে রূপশালি ধানে। আলের ধারে ধারে নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে বেলে কাঁকড়ার
সংসার । প্রবল বৃষ্টির ভেতর ক্রমশ আবছা হয়ে যাচ্ছে জসীমমামা। আর দাদু তার শৈশব
পেরনো নাতিকে শেখাচ্ছেন গাছ, পাখি, পতঙ্গের
ভাষা। তার বিস্ময়ের দরজা পেরিয়ে পেরিয়ে সেসব ঢুকে যাচ্ছে অন্তরে। বহু বহু বছর পর বিস্মৃতির
ধুলো ঝেড়ে তার সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে তারা। তারাই আবার পক্ষাঘাতগ্রস্ত সেই মানুষটির
খা খা শূন্য দৃষ্টির সামনে বছরের পর বছর তাকে দাঁড় করাচ্ছে। সেই দৃষ্টিতে প্রবল
শীত। ঝুপ করে অন্ধকার নামছে দিঘির জলে। সমস্ত পাতা ঝরিয়ে নির্ভার হতে চাইছে গাছ। সে
কিছুতেই এই অনির্বারতাকে স্বীকার করতে পারছে না। এই দৈন্যের কথা কাকে বলবে সে
অন্তর্গত অক্ষর গুলি ছাড়া! সেই ছোট্টবেলার মতো কার ছায়ায় জিরোবে ?
একদিন এই স্রোত আচমকা স্তব্ধ হয়ে গেলে সে অগনিত অবাঞ্ছিত শব্দের ভেতর নির্বাক বসে থাকে। সে জানে এরপর এই অনন্ত অপেক্ষাটুকুই শুধু তার ইচ্ছাধীন। তার আসার প্রত্যাশায় অসহায় বসে থাকাই তার ভবিতব্য। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়...।সে দেখে তার সামনে শস্যহীন আদিগন্ত খেত। যেন কোনও প্রবল তস্কর সমস্ত শস্য লুন্ঠন করেছে নিঃশেষে। দাউদাউ আগুনে পুড়ে যাওয়া বাড়ি। খাতা ভর্তি ছাই। মাথা ভর্তি ছাই। কোথাও কোন সবুজের চিহ্নমাত্র নেই। এরপর কার ছায়ায় সে আশ্রয় নেবে সে জানেনা। কাকে সে বলবে তার আত্মক্ষরণের কথা সে জানেনা। মাঝরাত্রে গলাধাক্কা খেয়ে যারা রাস্তায় এসে দাঁড়ায় তাদের কে আঁকড়ে থাকবে, সে জানেনা। তার ভয় হয়। এই অকরুণ রোদ্রচক্ষুর নিচে আমৃত্যু কাটিয়ে যেতে হবে তাকে!
পাখির শরীর থেকে যে পালক খসে পড়েছে বাদামি ঘাসে তার বিচ্ছেদব্যাথার
পাশে উপশম হয়ে কে থাকবে এরপর। শোকাহত পাখির মতো সেও বিরহব্যাথায় কাতর খড়কুটোর সন্ধানে বেরয়। মাঠ
পেরিয়ে, নদী পেরিয়ে, অরণ্য পেরিয়ে সে
উড়ে যায় আরও আরও দূরে। প্রত্যুষের নরম আলোয় ভিজে থাকা স্নিগ্ধ খড়কুটো কোথাও তার
অপেক্ষায় বসে আছে কতদিন। তাদের ঠোঁটে তুলে অপরাহ্নের পথে ফিরে আসে গাছে। বাসা
বাঁধে। নতুন সৃষ্টির দিকে মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। শিশুর কৌতূহলের মতো
মুহূর্তজীবি সে বিস্ময়। অন্যের লেখা ছুঁলে সে বোঝে তাদের লেখা জুড়ে তারাদের আলো,
পাখির কূজন। পুষ্পে পল্লবে ঝলমল করছে চারিপাশ। তার মনে হয় সারাদিন
এই আত্মঅভিভূত থাকা ধুলোবালির মতো শূন্যতায় ওড়াউড়ি ছাড়া কিছু নয় আর। এই ব্যার্থতার
গ্লানি তাকে ভেঙেচুরে দেয়। এই আত্মধিক্কার থেকে সে মুক্তি চায়। প্রতিটি অক্ষর থেকে
ছিটকে আসে উপহাস । সে বোঝে শব্দ এক অপরূপ কুহক। কিছুতেই সে ধরা দেয় না। তার মনে হয়
সে এক চির অসন্তুষ্ট পথভ্রষ্ট রৌদ্রবালক। প্রবল দহন দিনে তার মাথা থেকে অক্ষরের
ছায়াটুকু কেড়ে নিয়ে গেছে কেউ। সেই অক্ষরই তার আজন্মের ব্যথা। সেই অক্ষরই তার
ব্যথার পাশে চির উপশম।
ছবি - অর্ণব বসু
মুল ফরাসি থেকে কবি স্টিফান বুকে-র কবিতাভাবনার অনুবাদ
ঈশানী বসাক
ফরাসীতে একটি প্রবাদ আছে,"লে ডেজির উ যে সুই" অর্থাৎ
আমার মধ্যে যে ইচ্ছা বাস করে। ফরাসি প্রবাদ যদি ফরাসি কবিতার পাতার উপর রাখি তাহলে
বলা যায় একদম সঠিক। চিরকালীন পারি শহর কিংবা তার আশেপাশে যে কবি, গল্পলেখক অথবা চিন্তকদের
আনাগোনা তাদের ভাবনা এই বিশ্বে সর্বোত্তম ভিন্ন কিংবা আরো জমে যায় যদি বলি ইউনিক।
বোঁদলেয়ার, বঁনফোয়া কিংবা জারা, তাঁরা তো কিংবদন্তি কিন্তু এখনকার কবিরাও কম যান না।
এমনি এক কবির নাম স্টিফান বুকে। নাহ কবির ভাবনার প্রতিফলন ছোঁয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব
নয় তবে তাঁর কবিতা দিয়ে কিছু তো বুঝে ওঠা যায়ই৷
যেমন -
"মেট্রোতে আমি বই পড়ছিলাম
হঠাৎ মুখ তুলে দেখি
কোনো এক মঁসিয়ো দাঁড়িয়ে ফুল নিয়ে
আরেক হাতে পেস্ট্রি বক্স
না না আমার জন্য নয়
তবে অচেনা হলেও
একটা মুখ আর তার ভাবভঙ্গি
কত আশাপ্রদ হতে পারে
তা আমি নিজেকে দেখেই ভেবে শিউরে উঠছি।
কাল নামক আশা আমাদের ভিতরে বার বার দেখিয়ে দিচ্ছে যে প্রমাণ হলো তুমি যখন মানুষের দৈনন্দিন
কাজকর্মের ধারে দাঁড়িয়ে তা চাক্ষুষ আরম্ভ করেছো মাত্র।"
হ্যাঁ এই চমৎকার অর্থ প্রমাণ কথাটির আমি প্রথম শুনলাম। মানুষ যে বিস্মিত হয় আর বিস্ময়ের
মানে যে শহরে লুকিয়ে থাকে, ভিড়ের মধ্যিখানে তা মনে হয় স্টিফানের এই কবিতাই দেখাতে পারে।
মনে হবে সমস্ত ঘটনার যোগ আছে অথচ সব যেন অলীকবাস্তবতা। কাছে গিয়েও তার ছিড়ে দিচ্ছে।
ফিগ গাছের আলো কবিতার কয়েকটি পংত্তি পড়া যাক-
আমি যদি এত ক্লান্ত না হতাম তাহলে আমি আমাদের জন্য একটি বৈদ্যুতিক ল্যাভেন্ডার বানাতাম
যে সবসময় মধু বানিয়ে দিত, আমাদের গাছেদের জন্য ঝোপঝাড়, প্রজাপতি আর ডেঁয়োপিঁপড়ের দল
রেখে দিত। শুঁয়োপোকা থাকতো বেশ যা সৃষ্টি করতো অজানা সুখ।
সেই একই কবিতার অন্য স্তবকে তিনি লিখছেন-
আমার মেসেজবক্সে একটি ছবি
এক সৈনিক গলি পরিস্কার করছেন
আসলে আগ্নেয়গিরি জ্বলার পর সৈন্যদের কবরখানা বেশ ক্ষতিগ্রস্ত। সেনাটি ধীরে ধীরে সব
ময়লা সাফ করছেন। আমার এক বন্ধু বলতেন আমাদের সব দিনপঞ্জি সাজাতে হবে, কবে কী ঘটেছিল।
তারপর মৃত্যুর ক্যাম্প থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে তাদের।
আমরা যখন চলে যাওয়াকে নিয়ে দুঃখে মনমরা তখন স্টিফান স্ট্রাইক করছেন উদ্ধার অভিযানের
নীতিতে। এ এক এমন ভাবনা যা সোজা বিদ্রুপ করে বসে আমাদের সব কিছু হারিয়েছি নামক আর্তনাদকে।
একই কবিতার এমন সম্পর্ক, দুটো আলাদা দুনিয়া একসাথে আনার যে দুঃসাহস তা ওঁর "পরবর্তী
প্রেম" নামক সংকলনেই পাওয়া যাবে। তাঁর কবিতাভাবনা নিয়ে তার একটি দৃষ্টিভঙ্গি মাথায়
আসছে-
বলা নামক ক্রিয়াপদের জায়গায় কোনভাবেই ছোঁয়া বসিয়ে তাকে ভাবানুবাদ বলা যায় না বন্ধুরা।
এমন কথা ডিলানের গানের লাইন মনে করায় যেখানে ডিলান সৌন্দর্যকে নিজের বানানোর প্রতিশ্রুতি
রেখেছিলেন।
কবিতাকে এক আহত ডানাওয়ালা দ্বীপের সঙ্গে তুলনা করে কবিতা লিখেছিলেন আলেইন বস্ক।
" আসুন আলাপ করিয়ে দিই আমার কবিতাদের সঙ্গে। ওরা হলো উড়ন্ত দ্বীপ। এক বই থেকে
আরেক বইয়ে চলে যায়। আসলে নিজের জন্মের যে পাতা তাকে খুঁজে চলে। তারপর একদিন আহত হয়ে
আমার বাড়িতে বিশ্রাম নেয়। খাবার বলতে কিছু মাংস আর ঠান্ডা বাক্য।
যদিও ওঁর হঠাৎ এভাবে বাড়ি চলে আসার বেশ ভালোরকম মূল্য চোকাতে হয়েছিল আমাকে। আমার সমস্ত
সেরা শব্দ ঘুমিয়ে পড়েছিল কম্বলের তলায়। আমার সবুজ ছন্দ স্বপ্ন দেখতো এমন এক নিস্তব্ধতার
যা ঠিক তার নিজের মতোই তরুণ। "
এই ভাবেই সমস্ত রাগ উগরে দিচ্ছেন আলেইন। নিজের কবিতা যে কীভাবে নিজেকেই ভুলিয়ে দিতে
পারে আমাদের তার সাবধান বাণী জারি করে দিয়েছেন তিনি। হ্যাঁ বারবার জিজ্ঞেস করেছেন এর
ওষুধ। অবশেষে ক্ষুব্ধ হয়ে লিখে ফেলেছিলেন এক অভিমানী সন্তান হত্যার চিঠি। চলুন পড়া
যাক ঃ
"আমার কবিতা, যত তাকে বলি দূর হ
পঁচিশ বছর ধরে গায়ে পড়ে রয়ে গেছে সে।
আমার সমস্ত পান্ডুলিপি চুরি করে
যতই হতচ্ছাড়াকে আমি দূরের কোনো জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে আসি না কেন। তবুও সকালে নিঃশ্বাস ফেলতেই
দেখি আবার আমি লিখে ফেলছি একটা এপিটাফ। "
বাধ্যত এই বারে কবি মুক্তি পাবার জন্য অভিশাপ দিলেন, আমার প্রতিটি অক্ষর যেন প্যানথার
গিলে ফেলে যদি তারা আর ফিরে আসে।
হ্যাঁ এইভাবেই কবি মুক্তি চেয়েছেন কবিতার থেকে। আসলে কবিতা আমাদের ভিতর ছেঁকে সব সোনা
তুলে নেয়। আলেইন মূহুর্তে শান্ত হতে চাইছেন। তিনি আর পারছেন না এই দানছত্র করতে। এই
অভূতপূর্ব ভাবনার প্রতিফলন ফরাসি দেশেই পাওয়া যায়। আর তাই ফরাসিরা ভাবেন আজো যে একজন
কবির অনেক কিছুই বলার থাকে, অনেক খুঁটিনাটি। সব না বুঝলেও চলবে আমাদের।
ফুটনোট
আলেইন বিস্ক একজন ফরাসি অধ্যাপক এবং কবি যিনি জন্মগ্রহণ করেন ২৮ মার্চ ১৯১৯ সালে। কবিতা লেখা ছাড়াও বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদনা সফলভাবে করার জন্য তাঁকে বেলজিয়ান রয়্যাল আকাডেমি ফরাসি ভাষা এবং সাহিত্যের জন্য একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে মনোনীত করেন। মালারম এবং কেবেক এর মতো সম্মানীয় আকাডেমির সদস্যপদেও বিস্ক ছিলেন। তাঁর মৃত্যু হয় পারি শহরেই, ১৯৯৮ সালে। স্টিফান বুকে এই সময় ফ্রান্সের একজন নামী কবি ও প্রাবন্ধিক যার লেখার নতুন ধরন চমকে দিচ্ছে পাঠকদের। সেরগেই আইজেন্সটিন অথবা গুস ভন সঁতের মতো ফিচার ফিল্ম সৃষ্টিকারী ঈশ্বরদের নিয়ে তিনি লিখেছেন সারা বিশ্বকে তাদের চলচ্চিত্রের সঙ্গে পরিচয় করানোর জন্য। তাঁকে নিয়ে ফ্রাঙ্কফুর্ট কিংবা টরন্টো, সমস্ত জায়গাতেই আলোড়ন। ২০০৩ সালে প্রিক্স দে রোম নামক পুরস্কার গ্রহণ করেন তিনি।
ছবি - অর্ণব বসু
Post a Comment