দীপান্বিতা সরকার
কবিতার নিজস্ব ঈশ্বর
একা আমি৷ এই একা আমার মনোজগত, সাধনার জগত,
একাকী আমার ভাবনার গহীনতা নিয়ে আমি পৌঁছতে চাই তোমাতে, ছুঁতে চাই তোমাকে। আমার সমস্ত জীবনানুভূতিকে আবেগ, কল্পনা
আর মননের জারকে রাঙিয়ে আমি তোমার মনের অতলান্তে অবগাহন করতে চাই। জীবনের প্রতি
মুহূর্তবিন্দু, তার প্রতিটি পতনের শব্দ আমি জানতে, চিনতে চাই৷ তাকে রতনে ভূষণে সাজিয়ে যে রূপ দিয়ে তাকে তোমার মনোভুবনে হাজির
করি, তাই-ই তো আমার কবিতা৷ এই যে একান্ত আমি থেকে তোমার
অভিমুখে যাত্রা, তা একটি সামাজিক প্রক্রিয়া। কবিতা লেখা তাই 'একাকী মানুষের সামাজিক আচরণ'। আমার প্রতিটি পাঠক সেই 'তুমি'টি৷ আমার বোধ দিয়ে তোমার চেতনা, তোমার বোধকে উন্মীলিত
করতে করতে আমার কল্পনার সর্বস্ব আমি তোমাকে দেখাই, চেনাই৷ এই
চেনানোর তাগিদেই আনন্দ, দুঃখ, বিচ্ছেদ,
বিরহ বিষাদ সব যেন হয়ে ওঠে শিল্পীত সুন্দর। সেই সুন্দরের রূপ
দেওয়াতেই একজন কবিতাপ্রয়াসীর চির আনন্দ। সেই আনন্দেই আমি কবিতার কাছে আসি।
আমার প্রতিদিনের ব্যক্তিজীবন, সামাজিক জীবন নানা ঘটনার অভিঘাতে আহত, দীর্ণ, দ্বিধাজর্জরিত। অজস্র বয়ে যাওয়া মুহূর্তের অনুভূতি, আবেশ আপন মনোভূমির নিজস্ব পারিপার্শ্ব রচনা করে চলেছে। আর এই সমস্ত কিছুর মধ্যেই একটা চোরাস্রোতের মতন বয়ে চলেছে কবির মর্মশাঁসটি। অনুভূতিপ্রবণ মানুষের ইন্দ্রিয়গোচর ও ইন্দ্রিয়াতীত জ্ঞান ও উপলব্ধি অনেক গভীরে বিধৃত ও বিস্তৃত থাকে৷ তা সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক বেশি সুবেদী, সূক্ষ্ম ও সংবেদনশীল। একজন মানুষের আত্মজিজ্ঞাসা, প্রেমানুভূতি, দুঃখবোধ, বিচ্ছেদানুভূতি, আনন্দ বেদনা বিষাদের যত অন্তঃশীল যোগসূত্র, তা সবই তীব্রতর আকুল তরঙ্গাভিঘাতে নিত্য ক্রিয়াশীল একজন কবির মানসপটে। একজন কবি তাই বোধহয় সব সময় লেখেন। কাগজে কলমে, কী বোর্ডে না হলেও, মাথায়, মনে সে সব সময় লেখাকে ধারণ করে থাকে৷
আমারও অনেক সময়ই এমন মনে হয়৷ রান্না করতে করতে, ঘর গোছাতে গোছাতে, ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে, জীবিকার কেজো ঘিনঘিনে লেখা লিখতে লিখতেও আসলে আমি কবিতাই লিখি৷ আমার মন জগতের সব কিছু থেকেই কবিতার রশদ সংগ্রহ করে নিজেরই তাগিদে, নিজস্ব ভুবন রচনার তাগিদে, যে ভুবন না হলে আমার অস্তিত্ব প্রায় নেই বললেই চলে৷ আমার মন, আবেগ, বোধ, চিন্তন সমস্তটা একাত্ম করে একাগ্র করে আমি আমার জীবনের ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনাকে অনুবাদ করতে চাই কবিতায়। কবিতাই আমার সবচেয়ে সৎ সর্বাপেক্ষা গভীর আত্মঅভিব্যক্তি৷ খুব ছোটবেলায় অনেক কিছু এলোমেলোভাবে লিখে রাখতাম যাকে কবিতা বলা যায় না৷ কলেজ ম্যাগাজিনে প্রথম ছাপা লেখাটিকেও আর আজ কবিতা বলতে চাই না। যদিও সেটি অনেকের ভালো লেগেছিল৷ মনে পড়ে, লেখাটিতে কিছু উচ্চকিত সামাজিক বার্তা ছিল৷ কিন্তু কবিতা হয়ত ছিল না, আজ বুঝি৷ তখনও কিছুটা বুঝেছিলাম৷ আর সেজন্যই যতদিন না নিজে মনে করেছি কবিতা হয়েছে, ততদিন আর ছাপতে দিইনি কিছু৷ কবিতাসমাজে কীভাবে কোন নিয়তির পথ ধরে ঢুকে পড়লাম জানি না, কিন্তু লিখতে এসে যাদের সঙ্গে আলাপ হল, তাদের পেয়ে ভারি আনন্দ হল। তাঁরা কী সুন্দর কথা বলে, কী সুন্দর লেখে। আমার ভাবনার সঙ্গে কত মিল তাদের ভাবনা জগতে। কিংবা অমিল, অমিলটাও ভালো লাগে। এমন মানুষই তো এতদিন খুঁজছিলাম মনে হল৷ আমার লেখালেখির ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে বন্ধুদের ভূমিকা, অনুপ্রেরণা তাই অনস্বীকার্য। তারপর দূর থেকে কাছ থেকে কত প্রিয় কবিদের দেখলাম৷ কবিতা লিখতে এসে সঠিক ভাবে কবিতা পড়তেও শিখলাম। নিভৃত পাঠ, নিবিড় পাঠে কত যে মণিমুক্ত খুঁজে পেলাম! ধীরে ধীরে কবিতা লেখাই আমার জীবনের সমস্ত ঘটনাকে, নিয়তিকে নিয়ন্ত্রিত করতে লাগল।
আমার ব্যক্তিগত কবিতাভুবন জুড়ে রয়েছে এক নিজস্ব ঈশ্বর৷ জীবন থেকে তাঁকে আলাদা রাখতে পারি না৷ নিবিড়ভাবে সেই ঈশ্বর আসন পেতে আছেন আমার জাগতিক সমস্ত বোধে, কাজে ও যাপনে৷ সেই ঈশ্বর গভীর হৃদয়াবেগের, আধ্যাত্মের, প্রেমের। তাঁর দিকে অভিসারই আসলে আমার কবিতার দিকে যাওয়া৷ মাতৃগর্ভে থাকার সময় থেকেই সেই নিজস্ব প্রেমের ঈশ্বর আমার ললাটে, মুখভঙ্গিতে, জীবনভঙ্গিতে আলিপ্ত করেছেন কবিতাকে, এমনই আমার বিশ্বাস। আমি যখন অনেকদিন লিখি না, মানে সত্যি সত্যি কবিতা লিখি না, তখনও তিনি সঙ্গেই থাকেন আমার সকল কাজে, অকাজে, আলস্যে, আমার কবিতা হয়ে৷ আমার কবিতা আমারই তৈরি করা এক অবয়বঘোর, একটি আতপ্ত শরীর৷ তা কি আসলে আমারই আত্মা নয়? যে আত্মা প্রেমে, দুঃখে, শোকে, আদরে আঁচল বিছিয়ে নিজেকেই আশ্রয় দেয়, রক্ষা করে। কখনো কখনো নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতেও পারে না। কিন্তু লিখে চলে, কেঁপে ওঠে আকাশের নীচে৷ যে হৃদয়ে কবিতা আছে, বিশ্বাস করি সে সব শোক শুষে নিয়ে তাকে অনুবাদ করতে পারে ফুলে, রঙধনুতে, সবুজ পাতায়, মুক্ত নীল আকাশে৷
আমার প্রতিটি কবিতার বই আমার আত্মজ। আমি চলে গেলেও ওরা সন্তানের মত থাকবে৷ হয়ত সবার অলক্ষ্যেই থাকবে৷ তবু থাকবে। আমার কবিতা সেই সেই মুহূর্তে (যে মুহূর্তে জন্ম নিচ্ছে) আমারই মনের প্রতিবিম্বিত সৎ উচ্চারণ। আমার লিখিত একটি কবিতার একটি লাইনকেও তাই আমি অস্বীকার করতে পারি না। জন্মমুহূর্তে সে ছিল হৃদয়জাত। যাপিত জীবনের যে কোনও মুহূর্ত, তা ভুল হোক, ঠিক হোক, আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তেমনই তা থেকে উতসারিত কবিতার প্রতিটি শব্দও আমার কাছে ততধিক মূল্যবান ও সত্য।
ছবি -ফ্রিজ থলো
Post a Comment