নিত্যানন্দ দত্ত


দুপুরবালক ও স্নেহগাছের ছায়া 

যে ভ্রমর একমুখ পরাগের আশ্লেষ নিয়ে উড়ে যায় কলমিফুলের গায়ে তার না থাকার চিহ্নটুকু রেখে। বাতাসের গায়ে গায়ে তার উড়ে যাওয়াটুকু দৃশ্যপথের আড়ালে হারায়। হেমন্তের অপরাহ্নবেলায় নরম হাওয়ায় লকলক করে পূর্ণগর্ভ ধান। যা কিছু নয়নপথগামী, মুহূর্ত তাকে দৃশ্যের আড়াল করে। কিমবা আড়াল হয়না কেউই। নিঃশব্দে অন্তরে প্রবিষ্ট হয় । কত কত দিন পড়ে থাকে অচেতন। পুরনো দেরাজের মতো ধুলো জমে গায়ে। এইসব গুপ্তধনের কথা ভুলেই যায় সে। তারপর একদিন তারা তপ্ত লাভাস্রোতের মতো চেতন অবচেতন তোলপাড় করে ভাসিয়ে নিয়ে যায় তার সচেতন অবস্থানটিকে। তখন ভূতগ্রস্ত সে শুধু সমর্পন করতে পারে নিজেকে। যেমন হলুদ পাতাটি গাছ থেকে চ্যুত হয়ে মহাশূন্যে ঝাপ দেয় । সে জানেনা কোন মাটিতে স্থিত হওয়া তার ভবিতব্য। কোথায় যাবে সে জানে না। কোথায় যাওয়ার কথা ছিল সে জানেনা। শুধু সে জানে এই শূন্যে নির্ভার ভেসে থাকাটুকুই শুধু সত্য। 

 
এই যাত্রাপথটুকু শুধু সত্য। আবহমানের এই অনন্ত স্রোত, সত্য। আচমকা বিদ্যুৎচমকের মতো মাথায় অক্ষর এসে ভিড় করে। সেই ভিড়ে আরও আরও শব্দ এসে মেশে অবিশ্রাম। বাজারের কোলাহল, স্কুলের কর্কশ ঘন্টাধ্বনি, মিছিলের চিৎকার সবাই মিলে সেই নতুন আসা শব্দগুলিকে মুছে দিতে চায় প্রাণপণ। আর সে পাখিমায়ের মতো ডানার আশ্রয়ে আড়াল করে রাখে তার সদ্য শব্দশাবকদের। কেননা সে জানে তারাই আশ্রয় তার। একদিন যেমন ছিল সেই ছোট্ট কুটিরটি। তার খড়ের চাল। খড়ের দেওয়াল। আদিগন্ত খেতের মাঝখানে এক মহা পৃথিবী। 


সদ্য ফুল এসেছে রূপশালি ধানে। আলের ধারে ধারে
  নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে বেলে কাঁকড়ার সংসার । প্রবল বৃষ্টির ভেতর ক্রমশ আবছা হয়ে যাচ্ছে জসীমমামা। আর দাদু তার শৈশব পেরনো নাতিকে শেখাচ্ছেন গাছ, পাখি, পতঙ্গের ভাষা। তার বিস্ময়ের দরজা পেরিয়ে পেরিয়ে সেসব ঢুকে যাচ্ছে অন্তরে। বহু বহু বছর পর বিস্মৃতির ধুলো ঝেড়ে তার সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে তারা। তারাই আবার পক্ষাঘাতগ্রস্ত সেই মানুষটির খা খা শূন্য দৃষ্টির সামনে বছরের পর বছর তাকে দাঁড় করাচ্ছে। সেই দৃষ্টিতে প্রবল শীত। ঝুপ করে অন্ধকার নামছে দিঘির জলে। সমস্ত পাতা ঝরিয়ে নির্ভার হতে চাইছে গাছ। সে কিছুতেই এই অনির্বারতাকে স্বীকার করতে পারছে না। এই দৈন্যের কথা কাকে বলবে সে অন্তর্গত অক্ষর গুলি ছাড়া! সেই ছোট্টবেলার মতো কার ছায়ায় জিরোবে ?

একদিন এই স্রোত আচমকা স্তব্ধ হয়ে গেলে সে অগনিত অবাঞ্ছিত শব্দের ভেতর নির্বাক বসে থাকে।  সে জানে এরপর এই অনন্ত অপেক্ষাটুকুই শুধু তার ইচ্ছাধীন। তার আসার প্রত্যাশায় অসহায় বসে থাকাই তার ভবিতব্য। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়...।সে দেখে তার সামনে শস্যহীন আদিগন্ত খেত। যেন কোনও প্রবল তস্কর সমস্ত শস্য লুন্ঠন করেছে নিঃশেষে। দাউদাউ আগুনে পুড়ে যাওয়া বাড়ি। খাতা ভর্তি ছাই। মাথা ভর্তি ছাই। কোথাও কোন সবুজের চিহ্নমাত্র নেই। এরপর কার ছায়ায় সে আশ্রয় নেবে সে জানেনা। কাকে সে বলবে তার আত্মক্ষরণের কথা সে জানেনা। মাঝরাত্রে গলাধাক্কা খেয়ে যারা রাস্তায় এসে দাঁড়ায় তাদের কে আঁকড়ে থাকবে, সে জানেনা। তার ভয় হয়। এই অকরুণ রোদ্রচক্ষুর নিচে আমৃত্যু কাটিয়ে যেতে হবে তাকে!

 
পাখির শরীর থেকে যে পালক খসে পড়েছে বাদামি ঘাসে তার বিচ্ছেদব্যাথার পাশে উপশম হয়ে কে থাকবে এরপর। শোকাহত পাখির মতো সেও বিরহব্যাথায় কাতর খড়কুটোর সন্ধানে বেরয়। মাঠ পেরিয়ে, নদী পেরিয়ে, অরণ্য পেরিয়ে সে উড়ে যায় আরও আরও দূরে। প্রত্যুষের নরম আলোয় ভিজে থাকা স্নিগ্ধ খড়কুটো কোথাও তার অপেক্ষায় বসে আছে কতদিন। তাদের ঠোঁটে তুলে অপরাহ্নের পথে ফিরে আসে গাছে। বাসা বাঁধে। নতুন সৃষ্টির দিকে মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। শিশুর কৌতূহলের মতো মুহূর্তজীবি সে বিস্ময়। অন্যের লেখা ছুঁলে সে বোঝে তাদের লেখা জুড়ে তারাদের আলো, পাখির কূজন। পুষ্পে পল্লবে ঝলমল করছে চারিপাশ। তার মনে হয় সারাদিন এই আত্মঅভিভূত থাকা ধুলোবালির মতো শূন্যতায় ওড়াউড়ি ছাড়া কিছু নয় আর। এই ব্যার্থতার গ্লানি তাকে ভেঙেচুরে দেয়। এই আত্মধিক্কার থেকে সে মুক্তি চায়। প্রতিটি অক্ষর থেকে ছিটকে আসে উপহাস । সে বোঝে শব্দ এক অপরূপ কুহক। কিছুতেই সে ধরা দেয় না। তার মনে হয় সে এক চির অসন্তুষ্ট পথভ্রষ্ট রৌদ্রবালক। প্রবল দহন দিনে তার মাথা থেকে অক্ষরের ছায়াটুকু কেড়ে নিয়ে গেছে কেউ। সেই অক্ষরই তার আজন্মের ব্যথা। সেই অক্ষরই তার ব্যথার পাশে চির উপশম।
 

                                                                                                                                                             ছবি - অর্ণব বসু

 

No comments

Powered by Blogger.