ফরাসি কবি স্টিফান বুকে-র কবিতাভাবনা ও অন্যান্য
ঈশানী বসাক
ফরাসীতে একটি প্রবাদ আছে,"লে ডেজির উ যে সুই" অর্থাৎ
আমার মধ্যে যে ইচ্ছা বাস করে। ফরাসি প্রবাদ যদি ফরাসি কবিতার পাতার উপর রাখি তাহলে
বলা যায় একদম সঠিক। চিরকালীন পারি শহর কিংবা তার আশেপাশে যে কবি, গল্পলেখক অথবা চিন্তকদের
আনাগোনা, তাদের ভাবনা এই বিশ্বে সর্বোত্তম ভিন্ন কিংবা আরো সম্পূর্ণ হয় যদি বলি ইউনিক। বোঁদলেয়ার, বঁনফোয়া কিংবা জারা, তাঁরা তো কিংবদন্তি কিন্তু এখনকার কবিরাও কম যান না।
এমনই এক কবির নাম স্টিফান বুকে। নাহ কবির ভাবনার প্রতিফলন ছোঁয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়, তবে তাঁর কবিতা দিয়ে কিছু তো বুঝে ওঠা যায়ই৷
যেমন -
"মেট্রোতে আমি বই পড়ছিলাম
হঠাৎ মুখ তুলে দেখি
কোনো এক মঁসিয়ো দাঁড়িয়ে ফুল নিয়ে
আরেক হাতে পেস্ট্রি বক্স
না না আমার জন্য নয়
তবে অচেনা হলেও
একটা মুখ আর তার ভাবভঙ্গি
কত আশাপ্রদ হতে পারে
তা আমি নিজেকে দেখেই ভেবে শিউরে উঠছি।
কাল নামক আশা আমাদের ভিতরে বার বার দেখিয়ে দিচ্ছে যে প্রমাণ হলো তুমি যখন মানুষের দৈনন্দিন
কাজকর্মের ধারে দাঁড়িয়ে তা চাক্ষুষ আরম্ভ করেছো মাত্র।"
হ্যাঁ এই চমৎকার অর্থ প্রমাণ কথাটির আমি প্রথম শুনলাম। মানুষ যে বিস্মিত হয় আর বিস্ময়ের
মানে যে শহরে লুকিয়ে থাকে, ভিড়ের মধ্যিখানে তা মনে হয় স্টিফানের এই কবিতাই দেখাতে পারে।
মনে হবে সমস্ত ঘটনার যোগ আছে অথচ সব যেন অলীকবাস্তবতা। কাছে গিয়েও তার ছিড়ে দিচ্ছে।
ফিগ গাছের আলো কবিতার কয়েকটি পঙক্তি পড়া যাক-
আমি যদি এত ক্লান্ত না হতাম তাহলে আমি আমাদের জন্য একটি বৈদ্যুতিক ল্যাভেন্ডার বানাতাম
যে সবসময় মধু বানিয়ে দিত, আমাদের গাছেদের জন্য ঝোপঝাড়, প্রজাপতি আর ডেঁয়োপিঁপড়ের দল
রেখে দিত। শুঁয়োপোকা থাকতো বেশ যা সৃষ্টি করতো অজানা সুখ।
সেই একই কবিতারই অন্য স্তবকে তিনি লিখছেন-
আমার মেসেজবক্সে একটি ছবি
এক সৈনিক গলি পরিস্কার করছেন
আসলে আগ্নেয়গিরি জ্বলার পর সৈন্যদের কবরখানা বেশ ক্ষতিগ্রস্ত। সেনাটি ধীরে ধীরে সব
ময়লা সাফ করছেন। আমার এক বন্ধু বলতেন আমাদের সব দিনপঞ্জি সাজাতে হবে, কবে কী ঘটেছিল।
তারপর মৃত্যুর ক্যাম্প থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে তাদের।
আমরা যখন চলে যাওয়াকে নিয়ে দুঃখে মনমরা তখন স্টিফান উদ্ধার অভিযানের
নীতিতেই আঘাত করতে চাইছেন। এ এক এমন ভাবনা যা সোজা বিদ্রুপ করে বসে আমাদের সব-কিছু-হারিয়েছি-নামক আর্তনাদকে।
একই কবিতার এমন সম্পর্ক, দুটো আলাদা দুনিয়া একসাথে আনার যে দুঃসাহস তা ওঁর "পরবর্তী
প্রেম" নামক সংকলনেই পাওয়া যাবে। তাঁর কবিতাভাবনা নিয়ে তার একটি দৃষ্টিভঙ্গি মাথায়
আসছে-
বলা নামক ক্রিয়াপদের জায়গায় কোনভাবেই ছোঁয়া বসিয়ে তাকে ভাবানুবাদ বলা যায় না বন্ধুরা।
এমন কথা ডিলানের গানের লাইন মনে করায় যেখানে ডিলান সৌন্দর্যকে নিজের বানানোর প্রতিশ্রুতি
রেখেছিলেন।
কবিতাকে এক আহত ডানাওয়ালা দ্বীপের সঙ্গে তুলনা করে কবিতা লিখেছিলেন আলেইন বস্ক।
" আসুন আলাপ করিয়ে দিই আমার কবিতাদের সঙ্গে। ওরা হলো উড়ন্ত দ্বীপ। এক বই থেকে
আরেক বইয়ে চলে যায়। আসলে নিজের জন্মের যে পাতা তাকে খুঁজে চলে। তারপর একদিন আহত হয়ে
আমার বাড়িতে বিশ্রাম নেয়। খাবার বলতে কিছু মাংস আর ঠান্ডা বাক্য।
যদিও ওঁর হঠাৎ এভাবে বাড়ি চলে আসার বেশ ভালোরকম মূল্য চোকাতে হয়েছিল আমাকে। আমার সমস্ত
সেরা শব্দ ঘুমিয়ে পড়েছিল কম্বলের তলায়। আমার সবুজ ছন্দ স্বপ্ন দেখতো এমন এক নিস্তব্ধতার
যা ঠিক তার নিজের মতোই তরুণ। "
এই ভাবেই সমস্ত রাগ উগরে দিচ্ছেন আলেইন। নিজের কবিতা যে কীভাবে নিজেকেই ভুলিয়ে দিতে
পারে আমাদের তার সাবধান বাণী জারি করে দিয়েছেন তিনি। হ্যাঁ বারবার জিজ্ঞেস করেছেন এর
ওষুধ। অবশেষে ক্ষুব্ধ হয়ে লিখে ফেলেছিলেন এক অভিমানী সন্তান হত্যার চিঠি। চলুন পড়া
যাক -
"আমার কবিতা, যত তাকে বলি দূর হ
পঁচিশ বছর ধরে গায়ে পড়ে রয়ে গেছে সে।
আমার সমস্ত পাণ্ডুলিপি চুরি করে
যতই হতচ্ছাড়াকে আমি দূরের কোনো জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে আসি না কেন। তবুও সকালে নিঃশ্বাস ফেলতেই
দেখি আবার আমি লিখে ফেলছি একটা এপিটাফ। "
বাধ্যত এইবার যেন কবি মুক্তি পাবার জন্য অভিশাপ দিলেন ...।আমার প্রতিটি অক্ষর যেন প্যানথার
গিলে ফেলে যদি তারা আর ফিরে আসে।
হ্যাঁ এইভাবেই কবি মুক্তি চেয়েছেন কবিতার থেকে। আসলে কবিতা আমাদের ভিতর ছেঁকে সব সোনা
তুলে নেয়। আলেইন মূহুর্তে শান্ত হতে চাইছেন। তিনি আর পারছেন না এই দানছত্র করতে। এই
অভূতপূর্ব ভাবনার প্রতিফলন ফরাসি দেশেই পাওয়া যায়। আর তাই আজও ফরাসিরা ভাবেন যে একজন
কবির অনেক কিছুই বলার থাকে, অনেক খুঁটিনাটি। সব না বুঝলেও চলবে আমাদের।
ফুটনোট
আলেইন বিস্ক একজন ফরাসি অধ্যাপক এবং কবি যিনি জন্মগ্রহণ করেন ২৮ মার্চ ১৯১৯ সালে। কবিতা লেখা ছাড়াও বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদনা সফলভাবে করার জন্য তাঁকে বেলজিয়ান রয়্যাল আকাডেমি ফরাসি ভাষা এবং সাহিত্যের জন্য একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে মনোনীত করেন। মালারম এবং কেবেক এর মতো সম্মানীয় আকাডেমির সদস্যপদেও বিস্ক ছিলেন। তাঁর মৃত্যু হয় পারি শহরেই, ১৯৯৮ সালে। স্টিফান বুকে এই সময় ফ্রান্সের একজন নামী কবি ও প্রাবন্ধিক যার লেখার নতুন ধরন চমকে দিচ্ছে পাঠকদের। সেরগেই আইজেন্সটিন অথবা গুস ভন সঁতের মতো ফিচার ফিল্ম সৃষ্টিকারী ঈশ্বরদের নিয়ে তিনি লিখেছেন সারা বিশ্বকে তাদের চলচ্চিত্রের সঙ্গে পরিচয় করানোর জন্য। তাঁকে নিয়ে ফ্রাঙ্কফুর্ট কিংবা টরন্টো, সমস্ত জায়গাতেই আলোড়ন। ২০০৩ সালে প্রিক্স দে রোম নামক পুরস্কার গ্রহণ করেন তিনি।
ছবি - অর্ণব বসু
Post a Comment