বেবী সাউ-এর কবিতাগুচ্ছ


 

পাড় ভাঙা সনেটগুচ্ছ


১.

আমাদের সুস্থ রোগা নদী থেকে উঠে আসে বাঘ

বড়ই ক্ষুধার্ত। তার চোখে তাই মাংস লেগে নেই

যা দেব, তাতেই শান্তি। কে জানে সে গোপন যাকেই

কাছে ডাকে, তাকে কেন ঘিরে থাকে ঘৃণা, দ্বেষ, রাগ!

 

আমি কি চিনেছি তাকে? দূর থেকে শকুনের মতো

সে আমায় দেখে, শূধু দেখে যায়, আমিও তাহাকে 

দেখে যাই, যেন এই দেখা-শোনা নিয়তির ফাঁকে 

বিদ্রুপ করতে থাকে, আমি শুনি, হই না আহত। 

 

আহত কেনই বা হব? জঙ্গলের আধিপত্য ভাবি। 

তুমি কি ভীষণ চোখ? খিদে আছে? অলংকার জানো?

লিখেছ কঠিন শব্দ, ভেবে ভেবে অলস, বানানো?

পাওনি তেমন কোনও ঘর খুঁজে খুলে যাওয়া চাবি?

 

আমিও কবিতা খুলি, নগ্ন করি, এসো, ঘেমে যাও। 

আমার লাগামছাড়া পুকুরের মধ্যে ডূব দাও। 

 

২.

 

প্রতিকবিতার পাখি ওয়াক ওয়াক করে ডাকে। 

ঘনবরিষার রবি, তুমিই কি লিখেছ শ্রাবণ?

জয় গোস্বামীর কাব্য লিখেছ মেঘের ফাঁকে ফাঁকে?

জলের ভিতর দিকে এখনও তো শুয়ে আছে মন। 

 

কতটা শরীর চেন? শরীরের পরবর্তী দেহ 

চেন কি? গভীর খোলো। দেখ সাপ এঁকেবেঁকে যায়

সাপের নির্জন চলা যে বেদ চিনেছে তার গায়ে 

রয়েছে কবির দেহ, সে খোলস, রাবীন্দ্রিক স্নেহ 

 

দিইনি তাকেও, আমি, দেখেছি দ্যুভাল শুয়ে আছে

পাশেই রয়েছে শার্ল, দেখি তার চোখে যে বিষাদ 

তাকে আমি চিনি। কোন জামশেদপুরের সে স্বাদ - 

লিথির সমস্ত ঘুম ঢেলে দিই নগ্নতার কাছে। 

 

আমার প্রেমিক থাকে সেইদিকে, পাহাড়ের ছেলে 

যে জানে গোমুখ রোজ ভেঙে যায় কোহিনূর ঢেলে। 

 

 

৩.

 

আমি তো বিশ্বের কবি নই, জানি শুধুমাত্র পাখি 

আমার বিষাদ শুঁকে উড়ে আসে, ডানায় গরল

আমি লোকালের ট্রেন, হকার চলেছে বেঁধে দল,-

হাজার শব্দের বিজ্ঞাপনে তার জীবন অতল । 

 

আমাকে জ্ঞানের দেবী ভেবে যারা কল্পনায় লেখে ,-

তাদের দিয়েছি প্রাণ, আর কত সুর লিখব বলো

যে যৌনক্ষমতার কাছে বসে অন্ধকার রেখে 

আলোর কবিতা লেখে, তাকে দেব অসীম অ্যাপোলো। 

 

আমি তো শাস্ত্রের কিছু জানি না, জানি না সাধন 

জানি না তন্ত্রের খাতা, বুঝি না ভক্তির কারুকাজ 

শুধু এই ভাঙা ঘরে এসে পড়ে পঞ্চমুখী মন

কখনও মীরার গান, কখনও  বা  মহরম-তাজ । 

 

শোকের সমাধি চিনি, চিনি তার হৃদয়ে ঘাসফুল। 

সে আমার গয়নাগাটি, আমারই সে কানপাশা, দুল। 

 

 

৪.

 

ঈশ্বর গুপ্তের দেশে তবে কি আমার ঘরে সেই  

লেখা এসে পড়বে না? সে আমার আউটসাইডার। 

ভাঙা রাস্তাঘাট যেন, অনেকদিন পরে খোলা দ্বার--

 

ভাঙা ছন্দে কথা বলি, জামাকাপড়ের ছিরি নেই

সে আমারই কাছে বসে, বলি, তার পাশে জায়গা কই?

আমার দুপুর থেকে উড়ে গেছে সবই হইচই। 

 

লাশের উপরে ছন্দ লেখে কারা? কারা বলতে পারে

এ ঘর আমার নয়, নয় কোনও আরক্ত সন্ধ্যায় 

যে আমার শান্তিজল, যে আমার ভবিষ্যৎ চায়। 

 

কাকে দিতে পারি আমি এ শরীর, এই মন, চোখ?

জলের উপর কার ছায়া ভাসে? তোমার? আমার?

দিগন্তে অস্থির দৃশ্য, আমি তবে প্রেমিকা আবার?

 

চলো তবে, ঘন হই। ভেসে যাক কচুরিপানায় 

আমাদের গৃহ, বিষ, শস্যক্ষেত, মাঠ ভেসে যায়। 

 

 

 

নিপুণ করাতকল চলে ধীরে, কাছেই লোহার

দেহ ভাঙা দেহ পড়ে আছে, তার ঠিকানা অবশ

ঘরের ভিতরে দেখি, অন্ধকারে অসংযত তার

 

সাহসী প্রেমের দৃশ্য, কারা সেই দৃশ্যের অলস

কারিগর, জানি না যে। আমি তার রং শাসন করি। 

আমার কবিতা নয় আগুনের পাশে দারুরস। 

 

তোমার তান্ত্রিক দেহে আমি তাই সাধনসঙ্গিনী। 

আমায় সাধনা করো। ভস্ম দাও, ঘি দাও সুবাস। 

আমি যাকে কোনওদিন আমারই আয়নায় দেখিনি...

 

তাকেও যে দেখতে চাই, কে আমার বুকেই বাতাস

কে আমার কৃষিজল, কে আমার বীজ পরমায়ু--

কে তুমি সন্তান, আমি তোমাকেই করেছি প্রকাশ। 

 

যে মুঠোয় সুর বাঁধে, আমি তার ছন্দ লিখি আয়ু। 

আমার জীবন যেন জল, আকাশ, মাটি আর বায়ু... 

 

 

 

আজান শুনেছি, তুমি রামপ্রসাদ, মায়াবী কলম

এ সুর আকাশ ডাকে। আকাশেরও শরীর যে বাঁধা। 

কে তাকে ওড়ায়? বায়ু ? জল? দরিয়ার বুকে দম?

 

ঘন ঘন আকাশের দিকে তুমি তাকিও না আর

আমার চোখেই দেখ সে আকাশ, যেখানে রক্তের 

ছিটে লেগে আছে, তাকে চিনেছ কি গৌড়মল্লার?

 

যদি চলে যাই, আমি, ফিরে আসি, জানি, আসি, ফের

এত যে দূরত্ব আমি, তার কোনও পর্দা নেই বুকে। 

তুমি যে চালাও ক্ষুর, ভালবাস, এ গান ভক্তের?

 

এত কথা কেন বলো? এ কথা কি সুখে না অসুখে? 

ভেঙে পড়ে গেছে পাড়, নদী জানে কীভাবে সে ঢেউ

তুমি কি পেয়েছ ঘর? ' ভালবাসি' বলেছ কি মুখে? 

 

জানি কোনও রাস্তা নেই, তবু তার হাওয়া আসে, যায়। 

রক্তছিটে লেগে আছে দেওয়ালেই, বিপদসীমায়। 


ছবি- অর্ণব বসু 

 

No comments

Powered by Blogger.