অনির্বাণ মজুমদারের গুচ্ছ কবিতা


 

মধুমিতা 

 

 

 

মধুমিতা কিছু লাল রঙের তারা

পরাগরেণু আর চকলেট 

আমার বুক পকেটে গুঁজে  

বাস থেকে নেমে গেল ।

 

চালের গলির ভেতরে হারিয়ে যাওয়ার আগে 

একমুহূর্ত পিছন ফিরে তাকিয়ে ছিল...

 

যাদবপুর - আমার চেনা জায়গা নয়

সোজা রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করলাম

 

মধুমিতা কোথাও-না-কোথাও আছে |

 

অন্ধকার, দোকান বন্ধ 

বাড়িগুলোর ভেতরে মৃদু আলো জ্বলছে 

জানলা থেকে একটা হাত.... 

আমার মাথার উপর একটা বোতাম !

 

"জানলা খুলে গেছে তাই পাগল হইছে "

বলতে বলতে একটা লোক ছুটছে 

 

" চোখ খুললে কী হয় ? কী হয় ? 

"সাধু হয়..." 

তারপর আর শোনা গেল না ।

 

লোহার গেটের ফাঁকে দুটো আধপোড়া সিগারেট,

আমি সবুজ পুকুরের দিকে হাঁটতে লাগলাম 

 

মধুমিতা কোথাও না কোথাও আছে।

 

 

 

 

 

পুকুরের কাছে আসতেই 

কিছু হাত - জলের উপর 

টুসু গানের সুরে নাচতে লাগল

 

তর্জনীর ইঙ্গিত - পূর্ণচন্দ্র স্কুল 

স্কুলগেটের সামনে দেয়াল ঘড়ি এসে আছড়ে পড়ল পাশের উপরতলা থেকে

 

কাঁটা উল্টো দিকে ঘুরছে....

গেট পেরোতেই দেখলাম সন্ধে থেকে ক্রমে বিকেলমুখের আকাশ 

স্কুলবাড়ির পেছনে টিউবওয়েল 

একটা হাত ওড়নায় মুছে ভেতরে ঢুকল 

আর কোন শব্দ নেই 

 

অগত্যা বেরিয়ে ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করলাম 

একদিকে ইলেকট্রিক ব্লুজ 

অন্যদিকে সজোরে উলুধ্বনি 

 

কিন্তু মধুমিতা কোথায় ?

 

ডানদিকের মাঠে দোলনা, সি-স

পোড়ো বাড়িটার ভেতর থেকে 

হিন্দি গান আর মাংসের গন্ধ --

  

মাঠ পেরোতে সকাল হয়ে গেল

সামনে তিনটি রাস্তা 

বাঁ-দিকে মেঘ 

সোজা গত রাতের অন্ধকার 

ডানদিকে সকাল আটটার রোদ্দুর 

 

আলো আছে, 

মধুমিতাকে খোঁজার আরও সময় পাওয়া যাবে |

 

 

বাজারে

 

কিশোরীর বিস্ময় হাসি 

যেখানে বেলুনগুলো জড়াজড়ি করে 

আকাশের দিকে উড়ে যায় 

 

ফোকলা বুড়ো চেয়ে থাকে 

বুড়ি হাসে স্বভাববশত

দুঃখ নেই, রোগ নেই,মৃত্যু নেই 

 

সাদা আলোর অনন্ত বেলা....

 

 

 

 

বাজারের গলিতে চলতে চলতে 

ঢলে পড়বে কখন 

রাত 

নীরবতা 

সেই...

 

 

বাজার তল্লাটে বেণী দুলিয়ে 

হারিয়ে গেছে ছোট্ট মেয়েটি 

স্বপ্নে ডেকে যায় - "বাড়ি যাবো "

 

তাকে খুঁজতে, আরও গভীর স্বপ্নে ঢুকে পড়ি |

 

 

 

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত স্মরণে

 

নীল রাস্তা, নীল বাড়ি, দেয়াল, ছাদ 

সব ভিন্ন ভিন্ন নীল 

কোবাল্ট, রয়্যাল, ইন্ডিগো, টার্কোয়াস ,আলট্রামেরিন, নেভি, আকাশী 

 

দিন-মাস-বছর 

একটি ছেলে এমাথা থেকে ওমাথা দৌড়ে যাচ্ছে 

অবিরাম,

কার্পেট দুলে ওঠে 

ক্যানভাস আঁচলে লুটোয়... 

 

জানলা-দরজা-আলো-বাতাস গন্ধ সব নীল |

 

একটি ছেলে এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত দৌড়ে চলেছে 

দৌড়েই  চলেছে !

 

 

 

শহর থেকে 

 

সবুজ বেঞ্চি পাতা মিষ্টির দোকান -

কেউ আসে না,

তবু ঠাকুরের নামে ধূপকাঠি জ্বালিয়ে

মিষ্টি তৈরি হয় রোজ

তার পাশে

যে বুড়ো গোপাল-লক্ষীর পোস্টার বিক্রি করে

সে কতটা সুখী, কোনোদিন ভেবেও দেখেনি নিজে

 

সুখ নেই এ শহরে

সুখ নেই কোন শহরেই...

 

শাঁখ বেজে উঠবার আগে

জ্বলে ওঠে সন্ধে,

যদিও চাইনি ঢুকতে ওসব গলিতে

কিছু ঘটনা আমি দেখে ফেলেছি ভুল করে

 

তাই চোখে তুলে নিই সানগ্লাস, অন্ধকারেও...

 

জং ধরা বারান্দা থেকে বিপজ্জনক ঝুলে থাকা

কবেকার রঙচটা নেমপ্লেট

 

জেনো তারই নীচে বিদায়ভঙ্গিতে আমি

জ্বালিয়ে নিয়েছি সিগারেট।

 

 

বিদায় 

 

আমি তোমার জন্য রেখে যাচ্ছি

শান্ত সরোবর,

শুকনো পাতা বিছানো ফুটপাথ,

বাচ্চাদের হাসিভর্তি পার্ক,

খালি ট্যাক্সি...

 

আমি তোমার জন্য রেখে যাচ্ছি

নববর্ষের ডিসকাউন্ট ,

মে মাসের দুপুরের আইস-ক্রিম,

'নভেম্বরের বৃষ্টি'

বিকেলের লং-ড্রাইভ ।

 

আমি তোমার জন্য রেখে যাচ্ছি

 

গুণ্ডামির বিরুদ্ধে লেখা বেশ কিছু লাইন

সারাজীবনের বন্ধু - এমন একটা প্রেম

আড়ালে থেকে যাওয়া নিউজ-ফিড্

পথ হাঁটার জন্য একটা গান

 

আর এই পিছলে যাওয়া সময় ।

 

 

ছবি - অর্ণব বসু 

 

 

 


 

No comments

Powered by Blogger.